মানুষের সবচেয়ে প্রিয় কি? মানুষ নিজে, তাঁর নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, তাঁর পঞ্চ ইন্দ্রিয়। সেই অতি প্রিয় নিজস্ব জিনিস কি মানুষ সজ্ঞানে বিসর্জন দিতে পারে? না পারে না। অপারেশন করে পারতে পারে, তাছাড়া অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে মানসিক অবস্থা কেমন থাকে? ভয় ভয়! কি জানি কি হবে? ব্যাথার ভয়। মানসিক এই ভয় কাটিয়ে ওঠার জন্য ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়। তারপর তো এনেস্থেসিয়া দেয়ই। মানুষটির সম্পূর্ণ অজ্ঞান অবস্থাতেই যাবতীয় কাটা ছেঁড়া করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।
সজ্ঞানে নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিসর্জন দেওয়ার কথা শুধু গল্পেই পাওয়া যায়। সেই সব গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। কিন্তু গল্প যখন সত্যি, প্রান তখন শিউড়ে ওঠে, মনে সন্দেহ হয় – কি করে হতে পারে? আমাদের শরীরে একটু আঁচড় লাগলে ব্যাথায় কুঁকড়ে যাই।
সেই অতিমানবিক অঙ্গ বিচ্ছেদের সত্যি জীবন কাহিনী নিয়ে ছায়াছবি ১২৭ ঘণ্টা। এই গল্প Aron Ralston জীবনের সত্যি ঘটনা ।
Ralston খুব ভালোবাসতেন পাহাড়ে হাঁটতে, ট্র্যাকিং করতে। এমনকি ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি ছেড়ে শুধু মাউন্তেনিয়ারিং করার জন্যে চলে গিয়েছিলেন Colorado। কলোরাডো বিখ্যাত পাথুরে ক্যানিয়নের জন্যে।
একদিন তিনি Utah, Blue John Canyon এ হাইকিং করতে যান, কাউকে না জানিয়ে। slot canyon এর মাঝে নামতে গিয়ে এক বিশাল ঝুলন্ত পাথর পড়ে যায় আর তাঁর ডানহাত সেই পাথরের নীচে চাপা পড়ে যায়, কিছুতেই তিনি তাঁর হাত সেই বিশাল পাথরের নীচ থেকে বার করতে পারলেন না, তিনি হাত চাপা পড়ে আটকে গেলেন সেখানে। বিশাল সেই পাথরের ওজন প্রায় ৩৬০ কেজি। slot canyon দু’ধারে পাথরের দেওয়ালের মাঝে এক সরু গলি, শক্ত রশি ঝুলিয়ে গলির মধ্যে ওঠা নামা করে অভিযাত্রীরা।
বিশাল সেই পাথর নাড়ানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না। ধীরে ধীরে মৃত্যু বরণ করতে হবে এই জনহীন প্রান্তরে, কাউকে জানিয়েও আসেন নি যে তাঁর অনুপস্থিতিতে কেউ তাঁকে খুঁজবে। জলের ছোট বোতল আর কিছু খাবার ছিল তাঁর সঙ্গে, ধীরে ধীরে সেই খাবারও শেষ হয়ে যায়। সঙ্গে কোন মোবাইল ফোনও ছিল না।
পঞ্চম দিনে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে তাঁকে নিজের প্রস্রাব পান করতে হয়েছে। নির্জন পাথুরে মরুভূমির মতো এই জায়গায় পাথরের নীচে চাপা পড়া ডানহাত, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই তাঁর কাছে।
তিনি তাঁর ভিডিও রেকর্ডারে নিজের শেষ মুহূর্তের কথা রেকর্ড করছিলেন। বিদায় জানিয়েছিলেন নিজের পরিবারকে। সেই পাথুরে দেওয়ালে বাম হাত দিয়ে নিজের নাম, জন্মদিন আর আনুমানিক মৃত্যু দিন খোদাই করছিলেন। সেই অমানুষিক ব্যাথার সময়ে তাঁর নিজের ফেলে আসা জীবন যেন ছায়াছবির মত ভেসে উঠছিল। মানুষ যখন নিজের মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে, বাঁচার ইচ্ছা বোধহয় খুব প্রবল হয়, সেই অসীম বাঁচার তৃষ্ণা বোধহয় তাঁকে বাঁচায়।
ক্ষুধার্ত শারীরিক ভাবে দুর্বল মানুষটির মনে সেদিন বাঁচার ইচ্ছা ছিল প্রবল। পরে তিনি বলেছিলেন যে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে তিনি সেদিন যেন ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন কিংবা তাঁর হ্যালুসিনেশন হয়েছিল – তিনি এক সন্তানের বাবা হয়েছেন। কিন্তু যদি নাই বাঁচেন তো কি করে বাবা হবেন! তিনি বলেছিলেন – তাঁর ভবিষ্যৎ সন্তান তাঁকে বাঁচিয়েছিল। তিনি ঠিক করলেন বাঁচতে হলে হাত কেটে ফেলতে হবে। তাঁর কাছে সেদিন বাঁচার তৃষ্ণা এতো প্রবল ছিল যে ভোতা ছুরি যা সাধারণত অভিযাত্রীরা নিজেদের সঙ্গে রাখে তা দিয়ে নিজের হাত কাটতে শুরু করেছিলেন।
অ্যানাটমি বিদ্যার সাধারণ জ্ঞান না জেনেও বলতে পারি এ মোটেও সহজ কাজ নয়। শারীরিক ব্যাথা সহ্যের চেয়েও দরকার প্রচুর মানসিক শক্তি। রক্তমাংসের হাত কাটা সঙ্গে মোচড় দিয়ে হাড় ভাঙ্গা কি যে অমানুষিক যন্ত্রণা। কিন্তু, মুক্ত জীবনের হাতছানি যে আরও বেশি শক্তিশালী। তিনি ডান হাত কেটে ফেলেন, ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হতে থাকে, সেই অবস্থায় বাম হাতে রশি ধরে ৬৫ ফুট উঠে আসেন।
এপ্রিলের সূর্য মাঝগগনে, প্রখর রোদ্র তখন সেই পাথুরে মরুভূমির দেশে তীব্র উত্তাপ ঢেলে দিচ্ছে। ১৩ কিলোমিটার দূরে তাঁর গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। এই রক্তাক্ত কাটা হাত নিয়ে, প্রখর গরমে সেই গাড়ি পর্যন্ত যেতে এবং গাড়ি চালিয়ে লোকালয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রক্তক্ষরণেই তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করতেন কিন্তু ভাগ্য কিছুটা হলেও তাঁর সহায় ছিল। নেদারল্যান্ড থেকে এক পরিবার সেই সময় ওকে দেখতে পায়, দেখে খাবার জল ইত্যাদি দেয়, আর তাড়াতাড়ি সাহায্যের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানায়।
এইদিকে পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ, একদল খোঁজ পার্টি তাঁর খোঁজ করছিল। তাই সাহায্য পেতে খুব দেরি হয় নি, হেলিকপ্টারে করে তাঁকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে।
পরে কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিত্যক্ত হাত সেই ৩৬০ কেজি পাথর সরিয়ে উদ্ধার করে। সেই পাথর সরাতে ১৩ জন মানুষ ও প্রচুর যন্ত্রের সাহায্য লাগে।
তাঁর মুক্ত জীবন, স্বাধীন জীবন কিন্তু ৩৬০ কেজি পাথরের ভারে ন্যুব্জ হয় নি। তাঁর জীবন প্রমান করে জীবনের সাময়িক ব্যাথার ভারে ন্যুব্জ হওয়া জীবনের মূল লক্ষ্য নয়। জীবন এক স্বাধীন-মুক্ত আশার নাম, যে আশাকে সম্বল করে জীবনের বাজি ধরা ও জিতে নেওয়া। আজও তিনি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান। জীবন তাঁর থেমে থাকে নি। সেই আশ্চর্য মনোবল সঙ্গী করে আজ তাঁর পথ চলা।