বহুরূপে গোলাপি শহর তুলুস –পর্ব ১ (Toulouse, France)

দক্ষিণ ফ্রান্সে এসে ভ্যান-গখ ভাই থিও কে চিঠি লিখেছিলেন, “এখানকার ল্যান্ডস্কেপ উজ্জ্বল হলুদ রঙের পাথরে ভর্তি, গাছের পাতা অলিভ গ্রিন বা গ্রে গ্রিন… এখানকার শস্যখেতে একটা লালচে আভা আছে, আর পাহাড় গুলো যেন সুন্দর লাইল্যাক শেডে আঁকা…।” আবার ছোট বোনকে তিনি লিখেছিলেন, “ফ্রান্সের দক্ষিণকে কখনই মভের কালার প্যালেট দিয়ে আঁকা যাবে না… এখন প্রকৃতির কালার প্যালেট কত রঙ্গে ভর্তি – স্কাই ব্লু, অরেঞ্জ, পিঙ্ক, ভারমিলিয়ন, উজ্জ্বল হলুদ, উজ্জ্বল ওয়াইন রেড, বেগুনি…” ভ্যান গখ মুগ্ধ হয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রকৃতির অপরূপ রূপে, সৃষ্টি করেছিলেন অনবদ্য শিল্প।

DSC_0162 DSC_0169

ভ্যান গখের কথা কতখানি সত্যি তা দক্ষিণ ফ্রান্সের তুলুস শহরে না এলে বোঝা যেত না। তুলুস শুধু যে তার প্রাকৃতিক সৌন্দ্যযে ভরপুর তা নয়। তুলুস বিখ্যাত তার এয়ারবাস নিয়ে। তুলুসকে এয়ারবাস সিটিও বলা যেতে পারে, পৃথিবী বিখ্যাত Airbus  A 380 এই তুলুসেই তৈরী হয়েছে।

এই তুলুস (Toulouse) এলাকাকে চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে মিদি পিরেনিস পাহাড় শ্রেনী, তাই তুলুসের একটু বাইরে গেলেই চোখে পড়ে অপুর্ব সুন্দর প্রকৃতি। পাহাড়ের চুড়াতে সাদা বরফ জমে থাকে এই সামারেও, পাহাড় শ্রেনীর নিচে গ্রামের ছোট ছোট ছবির মত বাড়ি ঘর, ফ্রেঞ্চ গ্রামীণ জীবনযাত্রার ঝলক দেখা যায়।

DSC_0164ফ্রান্সের গ্রাম কেন যুগ যুগ ধরে কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকরদের টেনে এনেছে তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। এখানের প্রতিটি জিনিষ এত সুন্দর ভাবে সাজানো, এতো সামঞ্জস্যপুর্ণ, যেন মনে হয় কোন শিল্পির তুলিতে আঁকা। সামারে আবার কোলজা (colza) আর সুর্য মুখি ফুলের চাষ হয়। দিগন্ত বিস্তৃত উঁচু নিচু জমি হলুদ কোলজা আর সুর্য মুখি ফুলে ঢেকে যায়। হলুদ, সবুজ আর আকাশের নীল মারকাটারি রঙে ফ্রেঞ্চ গ্রামের ক্যানভাস আঁকা।

লাল ইটের এই শহরকে দেখেছি অনেক ভাবে, অনেক রূপে। এই শহরকে চিনেছি, দেখেছি।

DSC_0051DSC_0061

কখনও দেখেছি উৎসবের কার্নিভ্যালে জমজমাট, আবার কখনও গ্রীষ্মের দুপুরে নিশ্চুপ শহর, বৃষ্টি ভেজা শহর, শীতে জড় এই শহরকে দেখেছি।

DSCN9233 DSC02700

এই শহরের বুকে ঝিরি ঝিরি তুষারপাত দেখেছি, দেখে আনন্দে চিৎকার করেছি। এই শহরের আকাশে জমে থাকা ধূসর কালো মেঘ দেখেছি। আবার দেখেছি এই শহরের বুকে লুটিয়ে পড়া ভোরের কাঁচা সোনা রোদ।

DSC02196

প্রথম যখন এখানে আসি, প্লেন থেকে লাল ইটের এই শহরকে উপর থেকে দেখেই ভালো লেগেছে। তারপর ধীরে ধীরে সেই ভালো লাগা বেড়েছে। কোন কোন শহর মানুষের উপস্থিত সম্বন্ধে যেন খুব বেশি উদাসীন, মানুষ সেই শহরে যন্ত্র। কিন্তু, এই শহরের বুকে প্রান আছে। প্রান মুখরিত এই শহর মানুষকে আগলে রাখতে জানে।

এই শহরের আনাচে কানাচে জড়িয়ে আছে আমাদের অনেক অনেক স্মৃতির মুহূর্ত। ছুটির দিনে শীতের দুপুরে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া এই শহরে।

DSCN0443এই শহরের প্রতিটি রাস্তার সুবাস আমার জানা, জানি আমি কোন রাস্তা সদ্য ফ্রেঞ্চ ব্রেডের সুবাসে ম ম করে। রাস্তার মোড়ের প্রতিটি ভিখারি ও তার বাজানো সঙ্গীতের সুর আমার জানা।

এই শহরের মাঝবরাবর যে নদীটি বয়ে গেছে- গাড়ন (Garonne) নদী, সেই নদীর বাধানো ধার দিয়ে গ্রীষ্মের রবিবারের নির্জন দুপুরে হেঁটেছি অনেক দূর। দেখেছি এখানের মানুষের প্রতিদিনের জীবনের ছোট ছোট ছবি। কিছু ছবি মনে আর কিছু ছবি ক্যামেরায় জায়গা নিয়েছে।

DSC02744DSC_0728গাড়ন (Garonne) নদীর বাধানো ধার যে সর্বদা নির্জন তা নয়, এই নদীর ধারে কিছু না কিছু উৎসব লেগেই থাকে।

DSC_0718

কখনও হয় ‘বীচ ফেস্টিভ্যাল’, কখনও হয় খোলা আকাশের নীচে পেইন্টিং এক্সজিবিশান। বছরে একবার হয় ‘রিও লোকো’ (Rio Loco)- গানের উৎসব, অন্য জায়গার বড় সঙ্গীত তারকা আসে, জমজমাট হয়। এই নদীর ধারে জমায়েত হয় প্রচুর মানুষ।

DSC02733

এই শহরের কথা বলতে গিয়ে ক্যাপিটলের কথা না বললে যে অসম্পূর্ণ বলা হবে। এই ক্যাপিটল (capitole) তুলুসের মধ্যমণি। এই ক্যাপিটল তুলুসের বিখ্যাত থিয়েটার হল ও সিটি হল। সারা বছর এখানে কোন না কোন উৎসব লেগেই আছে। রেনেসাঁস সময়ের নিও ক্লাসিক্যাল স্থ্যাপত্যের নিদর্শন এই ক্যাপিটল, ১৭৫০ এ স্থাপনা। ক্যাপিটল বিল্ডিং এর ভেতরে রেনেসাঁস সময়ের দামি পেইন্টিং আছে দেওয়াল জুড়ে।

ক্যাপিটলের বিল্ডিং এর বাইরে বিশাল চত্তর সারা বছর জমজমাট। তুলুসে রাগবি খেলা হলে বিশাল স্ক্রিনে এই ক্যাপিটল চত্তরে রাগবি খেলা দেখানো হয়। ক্রিসমাস মেলা, ভাষা মেলা, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, ফ্ল্যাশ মব ডান্স, ভায়োলেট ফেস্টিভ্যাল আরও কতো কি হয় এই ক্যাপিটল চত্তরে। প্রতি বুধ বারে নানান জিনিষের বাজার বসে এই চত্তরে। এই বাজারে বই, জুতো, জামা থেকে নিয়ে দামি পেইন্টিং ও বিক্রি হয়।

DSC_0148

তুলুসকে নেকলেসের মতো জড়িয়ে আছে সুদৃশ্য UNESCO World Heritage Site ক্যানাল ডু মিদি। ক্যানাল ডু মিদি (Canal du Midi) ফ্রেঞ্চ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর এক অপরূপ নিদর্শন। ২৪০ কিমি এই ক্যানাল ডু মিদিকে দেখে মনে হয় ফ্রেঞ্চ শিল্পকলা আর ইঞ্জিনিয়ারিং মিলে মিশে একাকার। এই ক্যানাল ডু মিদি বহু পুরনো, তৈরি হয়েছিল ১৬৬৭ থেকে ১৬৯৪ এর মধ্যে। ফ্রেঞ্চ ইঞ্জিনিয়ার Pierre-Paul Riquet এই ক্যানাল ডু মিদির ডিজাইন করেন, এবং প্রায় তেষট্টি বছর বয়সে কাজ শুরু করেন। এই ক্যানাল অ্যাটলান্টিক ও মেডিটেরিয়ান সমুদ্রকে জুড়েছে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s