জন্ম থেকেই মানুষকে ঘিরে স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্বপ্ন উবে যায়, বা মানুষ ভুলে যায় তার স্বপ্নের কথা। কিছু কিছু স্বপ্ন আবার সারা জীবন পিছু ছাড়ে না, গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে তাড়া করে স্বপ্ন।
সুসান বয়েলের ছেলেবেলা সাধারণ। স্কটল্যান্ডের এক সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম এবং সাধারণ ভাবে বেড়ে ওঠা। শেখার অক্ষমতা (learning disability) ছিল ছেলেবেলাতেই, তাই স্কুলে সবাই তাঁকে ‘Susie Simple’ বলে ডাকত। সাধারণ সুসান বয়েলের হয়তো কোন আপত্তি ছিল না এই ডাকনামে, তবে সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো অন্যান্যদের সঙ্গে সহজে বন্ধুত্ব করতে পারতো না সুসান। নিজের মধ্যে ডুবে থাকতো সে। নিজের অক্ষমতা আড়াল করতে সুসান শিখছিল গান ও অভিনয়। গানে আর অভিনয়ে সেই অক্ষমতাকে লুকিয়ে দেওয়ার পথ খুঁজছিল। আর দেখেছিল একরাশ স্বপ্ন, স্বপ্নস্নাত সুসান বড় হয়ে উঠছিল।
কোনো শারীরিক অসুস্থতা বা কোনো মানসিক অসুস্থতা চলমান জীবনের স্রোত কে বাধতে পারে না।
জীবন এক চলমান স্রোত, ধাবমান উল্কা, উদাসীন বাতাস, উত্তুরে হাওয়া, বুনো ফুলের উগ্র মাতাল গন্ধ, চৈত্রের দগ্ধ আকাশ, ফাল্গুনের দখিনা বাতাস, কনকনে শীতের রাতের একমুঠো উষ্ণতা, একরাশ স্বপ্ন। একই জীবনের নানান রূপ, নানান দৃষ্টি ভঙ্গি, নানান ভাবনা, একেই তো বলে বেঁচে থাকা।
গ্রামের স্থানীয় চার্চে গান গেয়ে দিন কাটতো তাঁর। আর নানান টেলিভিশনের রিয়্যালিটি শো গুলোতে অডিশন দিয়েছিল সুসান। নিজের জমানো টাকা দিয়ে রেকর্ডও তৈরি করেছিল, আর সেই রেকর্ড পাঠাতো রেকর্ড কোম্পানি গুলোতে। সুসানের সরল, সিধে সাধা, সাধারণ ভাবমূর্তির জন্যে সুসান লোকের চোখে হাসির পাত্রও হয়েছিল। কিন্তু, জীবনের মধু যেমন দু’হাত ভরে আজলা করে পান করতে হয় তেমনি গরল টুকুও শিবের মত গলায় ধারণ ও করতে হয়।
সুসান স্বপ্ন দেখা ছাড়ে নি। স্থানীয় অনেক গানের প্রতিযোগিতা জিতেছিল সুসান। কিন্তু “Britain’s got talent” এর মঞ্চে অনেক শ্রোতা এবং দর্শকের সামনে গান গাইবে তা হয়তো ভাবে নি। সুসানের মায়ের উৎসাহে সে “Britain’s got talent”এ গাইল।
জীবনের সাতচল্লিশ বছর পার হয়েছিল স্বপ্ন দেখতে দেখতে। কিন্তু, স্বপ্ন দেখতে দেখতে এতগুলো বছর যখন পার হয়ে যায়, মনে তখন হয়তো দ্বিধা হয়। সুসানেরও দ্বিধা হয়েছিল। মঞ্চে যখন পৌঁছল সবাই ওর বয়স শুনে ভুরু কুচকে ছিল, যখন বলল Elaine Paige এর মতো জনপ্রিয় হতে চায় তখনও সবাই হেসেছিল। এক মধ্যবয়সী সাধারণ মহিলার কাছে যেন ব্রিটেনের জনতা এই উত্তর আশা করে নি, অতি সাধারণ সুসানকে অবহেলাই করেছিল সেদিন। কিন্তু “Britain’s got talent” এর মঞ্চে সেদিন ইতিহাস তৈরি হয়েছিল।
সুসান গাইল “I Dreamed a Dream’’। পাঁচ সেকেন্ডে সুসানের সুর শ্রোতাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যুৎ এর মত প্রবাহিত হল, সবাই রোমাঞ্চিত হল। সুসান গাইল, মন্ত্র মুগ্ধ জগত শুনল। মঞ্চ সেদিন জেগে উঠেছিল, হাততালির লহর বয়ে গিয়েছিল। সুসানের গলার সুর ছুঁয়ে গিয়েছিল উপস্থিত সবার হৃদয়। প্রথমে যারা হেসেছিল, ভুরু কুঁচকে ছিল এই মধ্যবয়সী সাধারণ মহিলার উপস্থিতিতে, তারা সবাই হাত তালি দিতে দিতে উঠে দাড়িয়েছিল সুসানকে সম্মান জানাতে।
তারপর সুসানকে আর পিছু ফিরে দেখতে হয় নি। 2009 এ প্রথম এ্যালবাম I Dreamed a Dream আন্তর্জাতিক বাজারে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। Elaine Paige এর সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিল সুসান এক টেলিভিশন শো এ। 2010 এ Time magazine সুসানকে পৃথিবীর মধ্যে সপ্তম প্রভাবশালী ব্যাক্তিত্ব বলে গন্য করেছিল।
তারপর একে একে সুসানের অনেক এ্যালবাম প্রকাশ হয়। সুসানের সুরে সাধারণ মানুষ নিজেকে যেন খুঁজে পায়, খুঁজে পায় স্বপ্ন দেখার সাহস, স্বপ্নের উপরে বিশ্বাস খুঁজে পায়, নিজেকে সুসানের সুরের সঙ্গে একাত্ম করতে পারে।
ভীরু পদক্ষেপে যার জীবনের শুরু সেই সুসান স্বপ্নের রাস্তা ধরে আজ আকাশের নক্ষত্র ছুঁয়েছে। এ গল্প তো রূপকথারই গল্প, যে গল্পের শেষে দুখি রাজকুমারী সুখে ঘরকন্যা করে, রানী হয়।
জীবন এক অদ্ভুত সংগ্রাম, যার প্রতিটি দিনে জড়িয়ে আছে রহস্যময়তা, প্রতিটি মুহুর্তে লুকিয়ে আছে অনিশ্চয়তা আর অসীম সম্ভাবনার বীজ। তাই এই জীবন সংগ্রামে জিতে যাওয়া খুব যে সহজ তা নয়। তবে জীবন সংগ্রামে জিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে কোন বাধা নেই। স্বপ্ন দেখায় সময়েরও কোন বন্ধন নেই, সুসান প্রমান করে দিল। সৈনিক মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পরে বৈ কি। আবার তেরেফুরে ওঠে ঢাল তলোয়ার নিয়ে রে রে করে যুদ্ধে নেমে পড়ে। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই, স্বপ্নকে তাড়া করেই জীবন চলছে, চলবে। স্বপ্ন দেখা ভুললে চলবে না। তাইতো আজ, পুরনো সিন্দুকে তুলে রাখা ধুলি ধূসর স্বপ্ন গুলোকে ঝেড়ে পুছে নতুন করে দেখার সময় হয়েছে।
Dreams are no more dreams …its time to blossom……