চল্লিশ বছর! সময়টা খুব একটা কম নয়। চল্লিশ বছর আগের এক অসম ভালবাসার কাহিনি দেখে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ চোখের জল মুছেছে। বিশ্বের পরিবেশবিদরা, পশুপ্রেমীরা আবার নতুন করে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে নড়েচড়ে ভাবতে বসেছে। নিষ্পাপ, নিরীহ এই ভালবাসার এই Youtube ভিডিও ইন্টারনেট দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেয়।
ব্যস্ত শহর লন্ডনের রাস্তায় যে সিংহের বাচ্চা বিক্রি হয় সে কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল? দুই অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু John Rendall এবং Anthony লন্ডনের হ্যারল্ড ষ্টোরে এক সিংহ ছানা দেখে হঠাৎ কিনে ফেলে। সিংহ ছানাটির করুণ চোখ মুখ দেখে বোধহয় ওদের দয়ার উদ্রেক হয়েছিল। কিংবা বলা যেতে পারে লন্ডনের বুকে সিংহ ছানা কেনার সাহস ওদের ছিল!
সিংহ ছানার নামকরণ হল ‘Christian’। তারপর তো সিংহ ছানা ধীরে ধীরে সিংহে পরিণত হতে শুরু করল। দৈর্ঘ্যে প্রস্থ্যে বাড়তে শুরু করায় লন্ডনের মতো জায়গায় ফ্ল্যাটে ওকে রাখতেও অসুবিধা হচ্ছিল। স্থানীয় চার্চের মাঠে Christian কে নিয়ে খেলতে যেতো ওরা। Christian এর ছোট ছেলে মেয়ে খুব প্রিয় ছিল। না, না খেতে নয়! ছোট ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খেলতে ভালোবাসতো Christian। আর ভালবাসতো দুই বন্ধুকে।
সিংহ নিয়ে তো আর লন্ডনে থাকা যায় না? তাই ঠিক হল, কেনিয়ার জঙ্গলে Christian কে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। Christian এর চাই এক নিজস্ব, স্বাধীন, মুক্ত জীবন, এক অরণ্যের জীবন। Christian তো জঙ্গলের রাজা, বন্যেরা বনেই সুন্দর। মানুষের সমাজের কুটকচালির ওরা কি ই বা জানে। মানুষ তো ওদের শিকার করে বন্দুক দিয়ে আর মৃত সিংহের বুকে পা দিয়ে বৃথাই বড়াই করে।
যাইহোক, এতদিনে Christian তো মানুষের সমাজে থেকে ওর বন্য ভাব অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে, মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছে। Christian কে তো আর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলেই চলবে না, ও মারা যাবে, হয়তো অন্য কোন সিংহের সঙ্গে লড়াইয়ে কিংবা কোন শিকারির বন্দুকের গুলিতে।
কেনিয়া সরকারের সঙ্গে কথা বলে কেনিয়ার এক প্রত্যন্ত জঙ্গল পাওয়া গেল, যেখানে শিকারি নেই, খুব বেশি বন্য সিংহ নেই। Christian কে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজে সাহায্য করবেন George Adamson। George Adamson বন্যপ্রাণী সংরক্ষক। তিনি ‘বাবা ইয়া সিম্বা’ সোহালি ভাষায় যার মানে ‘সিংহের বাবা’ – নামে পরিচিত। তিনি আগে এক অনাথ সিংহী ছানা Elsa কে বড় করেছেন এবং জঙ্গলেও ছেড়েছেন। তিনি বিখ্যাত ছিলেন তার সিনেমা ও বেস্ট সেলার বই Born Free এর জন্য।
জর্জ দেখলেন Christian যদিও মানুষের সঙ্গে থেকেছে কিন্তু তার বন্য পশু ভাব অনেকটাই বজায় আছে। শুরু হল Christian কে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়ার ট্রেনিং। “Boy” নামে আর এক সিংহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন জর্জ। “Boy” ও বিখ্যাত, ও Born Free সিনেমায় কাজ করেছে। শুধু “Boy” নয়, Katania নামে আর এক সিংহী ছানার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। এইভাবে Christian এর একটা পরিবার তৈরির চেষ্টা করা হল। ওরা তো পরিবার তৈরি করে। ধীরে ধীরে Christian জঙ্গলের রীতি নিতি জেনে নিয়ে পরিপূর্ণ এক সিংহ হয়ে উঠেছিল, এবং পরিবারের প্রধান হয়ে উঠেছিল।
সাফল্যের সঙ্গে Christian কে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জর্জ দুই বন্ধুকে বলে দিলেন এবার Christian বনের রাজা হল। মানুষের সঙ্গে সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। জঙ্গলের এই বিশাল বেড়ালের স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল, ওরা মানুষকে আর মনে রাখবে না।
এতদূর পর্যন্ত গল্প খুব সাধারণ। পৃথিবীতে সিংহ পোষার অনেক কাহিনী আছে, জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার কাহিনীও আছে, খাঁচায় রেখে পোষ মানানোর কাহিনী প্রচুর। কিন্তু, পোষা সিংহকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আবার খুঁজতে যাওয়ার কাহিনী কি আছে?
একবছর পরে যখন জর্জ দুই বন্ধুকে জানালেন যে Christian জঙ্গলে ফিরে গেছে, দুই বন্ধুর ইচ্ছে হল একবার শেষবারের মত Christian কে দেখে নেয়।
জর্জ বার বার বলেছিলেন Christian এতোদিন পরে হয়তো আর চিনবে না ওদের। বন্য প্রাণীরা ভুলে যায়- এটাই নিয়ম। দুই বন্ধু সারাদিন খুঁজে দিনের শেষে Christian কে খুঁজে পেল। দূর থেকে Christian সন্দেহ ভরা চোখে দুই বন্ধুকে দেখছিল আর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। Christian স্বাধীন জঙ্গলে থেকে আকারে অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। অনেকদিন পরে খুব প্রিয় মানুষ দেখে যেমন শিশু ছুটে আসে, ঠিক তেমনি করে Christian ছুটে এলো দুই বন্ধুর দিকে। লুটিয়ে পড়ল দুই বন্ধুর গায়ে, আদরে ভালবাসায় ভরিয়ে দিল দুই বন্ধুকে। অবিশ্বাস্য, অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী রইল পৃথিবীর মানুষ।
কিছুক্ষণ পরে Christian এর সঙ্গী দুই বন্য সিংহীও এসে দুই বন্ধুর পায়ে, শরীরে বড় বেড়ালের মতো মাথা ঘষতে শুরু করেছে। দুই বন্ধু আনন্দে আত্মহারা।
আশ্চর্য এই গল্প আবার নতুন করে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের ব্যাপারে এক নতুন আলোকপাত করেছে।