মণির কথা

মণিকে আমি চিনতাম। শান্ত মিষ্টি মেয়ে মণি পড়াশোনায় ছিল খুব ভালো। সেই মণি কালীপূজোর দিনটিকেই বেছে নিয়েছিল! বাইরে ছিল আলোর রোশনাই, বাজি ফাটার আওয়াজ। অমবশ্যার কালো রাতের আকাশে ছিল মিনিটে মিনিটে আলোর চমক – জীবনের কোলাহল, হাতছানি, উৎসবের আনন্দ।

না, মণি সেই আলোর উৎসবে নিজেকে নিমন্ত্রিত করতে পারে নি। ওর মনে তখন ছিল অমবশ্যার ঘন কালো অন্ধকার।

একদম পাশের লাগোয়া ফ্ল্যাটে ছিল মনির মা। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর মনির মা মেয়ের ফ্ল্যাটের পাশেই এক ফ্ল্যাট কিনে থাকতেন – দেখতেন নিজের সংসার চালাতে মনির যেন কোন কষ্ট না হয়, কোন অসুবিধা না হয়। চোখে চোখে রাখতেন।

মনিকে যে উনি বড্ড, বড্ড ভালবাসতেন – সেই কথাটি হয়তো তিনি তাঁর কাজ দিয়ে বোঝাতে চাইতেন।

না, উনি কোনদিনও মুখ ফুটে মেয়েকে ‘ভালোবাসি’ বলেন নি, নীরবে মনির কাধে হাত রেখে নৈঃশব্দের আকারে বলেন নি – আমি আছি – তিনি শুধু মনের গভীরে সেই ভালোবাসা লালন করে গেছিলেন – আরও সাধারণ মায়েরা যেমন করে তাদের সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা লালন করে – সর্বদাই মেয়ের ভালো চেয়ে, সরবে, সগর্বে যা প্রকাশ করা যায় – তিনি তাই করতে অভ্যস্ত ছিলেন।

তাই, মণি জানতেও পারে নি ওর মা ওকে অন্তরে কতটা ভালোবাসতো। আর মণিও হয়তো সেই জন্যেই নিজের মেয়েকেও বলতে পারেনি – মেয়েকে ও কতটা ভালোবাসে। এই ক্ষেত্রে ভালোবাসা ছিল এক ফল্গু নদীর চোরা স্রোতের মতো।

মনির মনে হয়তো কালি পূজার সেই কালো অন্ধকার রাতে অনেক অনেক না বলা কথা ভিড় করে আসছিল। তাই, কেরোসিনে সিক্ত হতে হতে মণি কি সেই সন্ধ্যেতে কাঁদছিল? কেরোসিনের সঙ্গে ওর চোখের জলও কি মিশে যাচ্ছিল?

হয়তো বা প্রত্যেকের জীবনেই এমন এক সময় আসে, যখন মনে হয় – না বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু, সেই মুহূর্তেই শান্ত এক মুখ ভেসে আসে, যে বলে – তুই চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো বল দেখি? আমাকেও তোর সঙ্গে নিয়ে চল। সেই মুখ মায়ের হতে পারে, মেয়ের হতে পারে, যে কোন ভালোবাসার মানুষের হতে পারে। ব্যস, তখনই সেই অর্থহীন চিন্তা চলে যায়।

তাই, প্রত্যেকের জীবনে এমন এক শান্ত স্নিগ্ধ মুখের প্রয়োজন, যে মুখের জন্যে আপাত অর্থহীন বাঁচাও এক অর্থ খুঁজে পায়, যে মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে জীবন লড়াই করে চলে, যে মুখের জন্যে জীবন আগুনের উপরে হাঁটতে হাঁটতেও হিমালয়ের হাওয়া অনুভব করে।

জীবন তো তাই শেখায় – অতল গভীরে ডুবে যেতে যেতে বাঁচার প্রচেষ্টা। মাঝে মাঝে জীবনে এক সময় আসে মনে হয় যেন এক ঘূর্ণি স্রোতে পড়ে গিয়ে এক দম সাগরের তলে গিয়ে ডুবে গেছে, কিন্তু, সেই সময়েই সাগরের তলদেশ এক ধাক্কা আসে, যা কিনা আবার ভেসে উঠতে সাহায্য করে।

হয়তো, মণি তার জীবন জুড়ে সেই শান্ত স্নিগ্ধ মুখের সন্ধান পায় নি। কিংবা ডুবে যেতে যেতে সাগরের তলদেশের সেই উপরমুখি ধাক্কার কথা ভুলে গিয়েছিল।

ওর ছয় বছরের মেয়ের মিষ্টি মুখও কি ওর আঁচল ধরে বলতে পারে নি? না যেও না! সেই ছোট্ট মুখ কি মনিকে এক বারও পথ আটকে দাঁড়ায় নি? নাকি কেরোসিন স্নাত মণি সেই মুখ গুলোর কথা একবারও ভাবে নি? কারোর মুখই কি সেই মুহূর্তে মনির মনের হাত ধরতে পারে নি!

নাকি, সেই মুহূর্তে মণি নিজের কথা ছাড়া পৃথিবীর আর কারোর কথাই ভাবতে পারে নি! না, আত্ম কেন্দ্রিকতায় উন্মাদ মণির সেই একান্ত শেষ মুহূর্ত গুলোর কথা কেউই জানে না। জানে না তার মনের গহন কোণের তীক্ষ্ণ টানাপড়েনের কথা – ভালোবাসাহীনতার কথা। সেই কালীপূজোর রাতে ওরা শুধু কয়লার মতো পুড়ে যাওয়া মনির প্রাণহীন দেহটিকেই আবিষ্কার করেছিল।

আসলে, পৃথিবীর বোধহয় কোন মানুষেরই তেমন করে বিশেষ প্রয়োজন নেই। আমরা পৃথিবীতে এসে নিজের প্রয়োজন তৈরি করে বাঁচতে ভালোবাসি। নিজেদেরকে অন্যদের কাছে প্রয়োজনীয় করে তুলি – ভালোবাসা দিয়ে, বন্ধুত্ব দিয়ে, প্রেম দিয়ে, আদর দিয়ে, সহিষ্ণুতা দিয়ে। আর যখনই নিজের সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে শুরু করে বাঁচাটাকে অর্থহীন বলে মনে হয়।

মণি হয়তো কোন স্থানেই নিজেকে প্রয়োজনীয় ভাবতে পারে নি, নিজের জন্যেও নয় – আর হয়তো নিজেকে প্রয়োজনীয় ভাবতে না পারাটাও জীবনের এক মস্ত পরাজয়। অন্যের কাছে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাক না কেন ক্ষতি নেই – নিজের কাছে নিজের প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে না যায়। নিজেকে জানা, চেনা, ভালোবাসা, নিজেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে এক গোটা জীবনও যে বড্ড কম পড়ে যায়।

আর জীবনকে ভালবাসতে হলে, রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, তাঁর কাছেই আশ্রয় নিতে হয়। মনে হয় – জীবনের সমস্ত হতাশা, পরাজয়ের আশ্রয় ঐ মানুষটার কাছে আছে। একবার তাঁর কথাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করলে বোঝা যায় জীবনের গভীরতা, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য।

জীবনে তো বার বার মানুষকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয় – জীবন মানে এক দীর্ঘ ধৈর্য – এক অপেক্ষা থেকে আরেক অপেক্ষার নাম জীবন – আমরা অপেক্ষা করতে ভালোবাসি। এক একটি অপেক্ষা তৈরি করে যায় জীবন – এও তো বাঁচার এক আনন্দ, যে দিন সেই অপেক্ষারা ফুরিয়ে যায়, সেই দিন হয়তো বাঁচাও শেষ হয়। মণি হয়তো সেই অপেক্ষা তৈরি করতে পারে নি।

কিংবা মণি দুর্যোধনের মতো যুদ্ধে পরাজয় জেনেও বীর দর্পে বলতে পারে নি – বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী। মেয়েকেও বলতে পারে নি – আমার হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখ, প্রেম, অপ্রেম, হাতাশা, টানাপড়েন, জীবন যুদ্ধ – সব দিয়ে সাজিয়ে দিলাম তোকে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Uncategorized and tagged , , . Bookmark the permalink.

1 Response to মণির কথা

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s