[সালটা ছিল বাহাত্তর। শিলচর আকাশবাণী কেন্দ্রের শুরুর দিনগুলোর কথা। সেই সময়ে মফঃস্বল শহর শিলচরের বিনোদন বলতে ছিল রেডিও, নাটক, যাত্রা, সাহিত্য, কবিতা আর গল্প। শরৎ কালে এই মফঃস্বল শহরের প্রকৃতি ও মানুষ মেতে উঠত আগমনীর সুরে। সেই সময়ে শারদোৎসব উপলক্ষে রেডিওতে যে অনুষ্ঠান গুলো হতো, তার এক স্ক্রিপ্ট আমার হাতে আসে। লিখেছিলেন – সৌমেন্দ্রনাথ চৌধুরী। বাহাত্তরের শারদোৎসবের সেই সময় যেন উঠে এসেছে এই স্ক্রিপ্টে। তাই শারদোৎসব উপলক্ষে একটু স্মৃতি চারণ করি, সেই দিনের রেডিওর অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্টটি সবার সঙ্গে শেয়ার করি ]
#এসেছে শোভন শরৎ ঋতু। বর্ষণ শেষে বিদায় নিয়েছে ঘন মেঘের পুঞ্জ; সুনীল আকাশে সাদা মেঘের আলস্য। আলোতে এখন স্বর্ণ চাপার আভা, শিশির স্নিগ্ধ শীতল বাতাস শিউলির সুগন্ধে ভরপুর; কমল বনের ফুল্ল হাসিতে শারদীয় উৎসবের আমন্ত্রণ চিঠি।
আমাদের ভেতরে যে আলস্যের উপাদান আছে, শরৎ যেন তার বহিঃপ্রকাশ। আকাশের নীল থেকে আরম্ভ করে, দিনের উদাসী বাতাস আমাদের ছুটির ডাক দেয়- আর সঙ্গে সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় এই ছুটির অবকাশে আমাদের মা আসছেন – যার আগমনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীর জাতীয় উৎসব শুরু হয়।
বাঙ্গালীর কাছে দুর্গা শুধু দেবী নন, তিনি ঘরের কন্যাও। বাঙ্গালী জাতি আবেগ প্রবণ বলেই দেবীর সঙ্গে শুধু ভক্ত ভগবানের সম্পর্ক রাখেনি। তাঁকে একেবারে ঘরের মেয়ে করে, কন্যা-বিরহের বেদনা ও তার আগমন-জনিত আনন্দকে মায়ের প্রান দিয়ে অনুভব করেছে। দেবীর আসা ও চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বহুদিন ধরে রচিত হয়ে আসছে আগমনী গান –
এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাবো না …
কিংবা, যাও যাও গিরি আনিতে গৌরি…
# এডওয়ার্ড টমসন বলেছিলেন – তোমাদের দেশ কবিতার দেশ।
কথাটির অর্থ যদি এই হয় – এখানকার সবাই শুধু কবিতাই লেখে, তবে ভুল হবে। শুধু এই বুঝবো – কোন রকমের দুঃখ দারিদ্র্য হতাশা লাঞ্ছনাই আমাদের জীবন থেকে কবিতার প্রতি নিগুঢ় অনুরাগ নষ্ট করতে পারে নি। কবিতা বিলাস নয় – বাঁচার পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়।
কবিতা যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন, তার বিষয় বস্তু, শব্দ চেতনা, ছন্দ-সৌকর্য পার হয়ে শেষে ধ্বনি-সম্ভব এক আলোক-সামান্য রূপের জন্ম দেয়। আজ মহালয়া। এই উপলক্ষে কাছাড়ের কয়েকজন কবি তাঁদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাচ্ছেন।
[সেদিন কাছাড়ের বেশ কয়েকজন কবি তাঁদের লেখা কবিতা পাঠ করেছিলেন]
# মা আসছেন। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে শুভ বোধনের ধ্বনি। সিংহবাহিনী বরাভয় প্রদায়িনী রূপে তিনি আবির্ভূতা হবেন। একদিন তিনি রামচন্দ্রকে এই শরৎ কালে আবির্ভূতা হয়ে রক্ষা করেছিলেন। তিনি শক্তিরূপিণী মহামায়া। তিনি তার সন্তানদের শক্তি দেন। আমাদের প্রার্থনার বীজ মন্ত্র হোক – মাভৈঃ।
জগতের অসত্যকে নিধন করার জন্যেই ছিল রামের সমর যাত্রা। তাই শক্তি রূপিণী মা তাকেই সাহায্য করেছিলেন। সত্য যা, তা চিরস্থায়ী, তার বিনাশ নেই। মহাকাশে বড় উল্কাপাতে মুহূর্তে চোখ ধাঁধিঁয়ে দেয়, কিন্তু, দুর্যোগের রাতে নীহারিকার ক্ষুদ্র আলোই পথিকদের পথ দেখায়। ক্ষণিকের উজ্জ্বলতা তার মধ্যে নেই, কারণ সে চিরসত্য।
শরতের আলোক একদিকে রচনা করেছে জয়ের আনন্দ, এবার এই আলোকের ঝর্ণা ধারাতেই নব-পত্রিকার স্নান। শেষে আবৃত্তি করে বোধনের মন্ত্র, আত্ম শক্তির মন্ত্র, কল্যাণব্রতী মানুষকে যা পরিচালিত করছে অমৃতের পথে, সত্যের পথে। শ্রেয়-বোধের ইঙ্গিতে যে পথের সন্ধান মেলে।
ক্ষমতা নয়, দম্ভ নয়, বাহুবল নয়, তার চেয়ে বড় মানুষের মঙ্গল কামনা, মানবতার যথার্থ মর্যাদা।
চলবে