ভার্সেই রাজ বাগানের ফোয়ারা (The Latona Fountain, Gardens of Versailles, France)

ডিসেম্বরের উজ্জ্বল হলুদ সকালে যখন প্যারিসের কাছে, ভার্সেই প্যালেসে পৌঁছলাম, শীতের নরম মৃদু রোদ্দুর তখন বিশাল ঐ রাজপ্রাসাদ ও রাজ বাগানকে সাজিয়ে তুলছিল। ঘাসের উপরে জমে থাকা কুচি বরফ, ধীরে ধীরে গলে গলে পড়ছিল। অদ্ভুত এক হলুদ আভায়, সেইদিন ভার্সেই প্যালেস ও তার সামনের বিশাল রাজবাগানকে যেন কোন এক রূপকথার রাজ্য বলে মনে হচ্ছিল।

ভার্সেই প্যালেসে গিয়ে প্রথমেই, ভার্সেই প্যালেস ও গ্র্যান্ড ক্যানালের মাঝের বিশাল বাগানে, ওয়েডিং কেক স্টাইল, মানে ধাপে ধাপে তৈরি যে ফোয়ারাটি দেখা যায় – নাম তার Latona Fountain ।

ফ্রান্সের রাজা লুই চোদ্দ, সতেরো শতাব্দীতে, যখন তার রাজপ্রাসাদ প্যারিস থেকে ভার্সেই এ স্থানান্তরিত করেছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন, তার রাজ বাগানের মধ্যে এক অপূর্ব সুন্দর ফোয়ারা তৈরি করবেন – যা দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকবে না।

আর, সেই ফোয়ারা তৈরির জন্যে তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই জায়গা, যেখানে রাজা লুই তেরোর সময়ে ডিম্বাকৃতি এক পুকুর ছিল। সেই পুকুরকেই তিনি ফোয়ারায় পরিণত করার পরিকল্পনা করেছিলেন।

আর রাজা লুই চোদ্দ নিজেকে সান কিং হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, এই ফোয়ারা সূর্য দেবতা অ্যাপোলো, যাকে তিনি তার সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন, সেই সূর্য দেবতা অ্যাপোলোর ছেলেবেলার গল্প বলবে। এই ফোয়ারাকে রূপ দেওয়ার জন্যে সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্পী Marsy  ভাইদের ডেকেছিলেন।

আজ Latona Fountain কে যে রূপে দেখা যায় – এই রূপে আসতে তাঁকে সময় ও সংরক্ষণের অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। ধাপে ধাপে এই বিশাল ফোয়ারা তৈরি হয়েছিল। প্রথমে দেবী Latona র ভাস্কর্যটি অন্যান্য ভাস্কর্যদের সঙ্গে একই লেভেলে ছিল – কিন্তু, কিছুদিন পরে দেবী Latona কে পিরামিড ধাপের একদম চূড়ায় স্থান দেওয়া হয়েছিল।

Latona গ্রীক পুরাণের দেবী, সূর্য দেবতা অ্যাপোলোর মা। তাই, এই ফোয়ারার একদম কেন্দ্রের উঁচু জায়গায় দেবী Latona  কে তার শিশু পুত্র সূর্য দেবতা অ্যাপোলো ও কন্যা ডায়ানা সহ দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে এই ভাস্কর্যের দিক ও পরিবর্তন হয়েছিল।

সতেরো শতাব্দীতে যখন এই ফোয়ারা তৈরি হয়েছিল, দেবী Latona  র ভাস্কর্যটি রাজপ্রাসাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, পরে, এই ভাস্কর্য রাজপ্রাসাদের দিকে পেছন ফিরে, দিগন্তের দিকে মুখ করে ছিল – আজও এই ভাস্কর্য দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে থাকে, যে দিগন্ত রেখায় গ্র্যান্ড ক্যানালকে দেখা যায়।

ইউরোপের প্রতিটি জায়গায় এক একটি ফোয়ারা যেন এক একটি গল্প বলে, এক একটি সংকেতের দিকে নির্দেশ করে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই ফোয়ারাও ফরাসী রাজা লুই চোদ্দর রাজ দরবারের শৌর্য, শাসন, যুদ্ধ ও বিচারের কোন এক সংকেতের গল্প বলে।

যাইহোক, ডিসেম্বরে ভার্সেই বাগানের ফোয়ারারা সব শান্ত, স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ, মারাত্মক ঠাণ্ডায় ফোয়ারার জল জমে বরফ হয়ে যায়। এই সময়ে, তাই ফোয়ারার জলের আড়ালের স্থ্যাপত্য গুলোকে স্পষ্ট বোঝা যায়। সামার এলেই সেই শান্ত ফোয়ারারা আবার জেগে যায়। তখন ফোয়ারা, সুর ও ফুল সব নিয়ে, ভার্সেই বাগানকে ফোয়ারার স্বর্গরাজ্য বললেও মনে হয় খুব একটা ভুল বলা হবে না।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel, Western-Europe and tagged , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান