মিটার গজ ট্রেনের কথা (Metre-gauge railway)

Meter gauge train line.JPG

শিলচর থেকে লামডিং – মিটার গজ ট্রেন লাইন ছিল। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, এই ট্রেন লাইন ধরে যখন ছোট ট্রেন দীর্ঘ এক সিটি বাজিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে, দম নিতে নিতে পাহাড়ি লাইন ধরে পাহাড় পেরিয়ে যেত, ট্রেনের সেই দীর্ঘ সিটি ঘন সবুজ জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে মিলিয়ে যেত, জানালার ধারে বসে সেই জঙ্গল পাহাড়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে অনেকেরই মন উদাসীন হয়ে যেত, হু হু করে উঠত।

ট্রেন লাইনের দুই ধারে বন্য সবুজের গভীরতা, বন্য আদিম সুবাসকে ছেড়ে আসতে বোধহয় সেই ছোট্ট ট্রেনের কষ্টই হতো – তাই ঐ দূরত্বটুকু পার হতে ট্রেনটি প্রচুর সময় নিত। ধীরে সুস্থে থেমে, সবারই কুশল মঙ্গল জেনে নিতে নিতে ট্রেনটি এগিয়ে যেতো। আবার কখনো জংলী হাতির দল ঐ ট্রেনের রাস্তা আটকে দিত।

ট্রেনের সিটি শুনে দুই পাশের গ্রামের বাচ্চারা দৌড়ে, ট্রেন দেখতে আসতো। ঐ পাহাড়ি বন জঙ্গলের দেশে মিটার গজ ট্রেনটিই যেন সভ্যতার এক যোগ সূত্র ছিল।

দুই পাশে বন্য সবুজের আদিমতাকে সাক্ষী করে নিয়ে, এই ট্রেন এতই ধীরে ধীরে চলতো – যে এই ট্রেনের গতি নিয়ে স্থানীয়রা অনেকেই কৌতুক করতো। হঠাৎ-ই ট্রেনের ছন্দ বদলে যেত, বোঝা যেত, এবার ট্রেনটি দয়াং রেল সেতু পার হচ্ছে। আর সেই শিলচর থেকে লামডিং – এই ট্রেন লাইনে, ছোট ও বড় মিলিয়ে উনত্রিশটা পাহাড়ি টানেল ছিল।

আর গভীর রাতে যখন সেই ট্রেন, আদিম অন্ধকার বন্যের মধ্য দিয়ে সিটি বাজিয়ে পার হতো, গভীর জঙ্গল ও তার প্রাণীরা একটু যেন সজাগ হয়ে যেতো, কিংবা পাশ ফিরে শুতো। আর চাঁদনী রাতে জঙ্গল যখন এক গভীর রহস্যময় হয়ে যেতো, জঙ্গলে আলো ছায়ার এক অদ্ভুত মায়া জগত তৈরি হতো, চন্দ্রিমা যেন গোটা জঙ্গল পাহাড়কে ধুইয়ে দিত – আর ছোট্ট ট্রেনটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে, দিব্যি ধীর ছন্দে এগিয়ে যেত। পূর্ণিমার গভীর রাতের সেই জঙ্গল ও ট্রেনের সেই অদ্ভুত যুগলবন্দী নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্টই হয়।

একবার যে ঐ ট্রেন যাত্রা করেছে – তার স্মৃতিতে ঐ জঙ্গল পাহাড়ের বন্য সবুজের আদিমতা, রহস্যময়তা যেন গ্রথিত হয়ে রয়ে যায়।

পথে পড়ত হাফলং, জাটিঙ্গা ষ্টেশন। ছোট্ট ষ্টেশন গুলোতে স্থানীয় মানুষ বিক্রি করতো জাটিঙ্গার কমলালেবু কিংবা জঙ্গলের কলা, আঁখ। গুটিকয় মানুষ হয়তো সেই স্টেশনে নামল – তাছাড়া, সারা দিনই ষ্টেশন গুলো ফাঁকাই থাকে। দিনের কিছু সময়ই ঐ ষ্টেশনের ব্যস্ততা, মানুষের আনাগোনা, তারপর আবার শান্ত।

ছেলেবেলার সেই ট্রেন, গভীর সবুজ জঙ্গল পাহাড়, ট্রেনের দীর্ঘ সিটি দিয়ে পাহাড়ি পথে উপরে ওঠা, ডাবল ইঞ্জিনের হুঁশ হুঁশ করে দম ফেলার আওয়াজ, হু হু করে ওঠা মন, উদাসীনতা – সবই যেন আমার ছেলেবেলার ট্রেন যাত্রার এক স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। আজ সেই মিটার গজ লাইন নেই, সেই ট্রেনও নেই, সেই ট্রেন সেতুও নেই – সবই আজ ইতিহাস। কিন্তু, সেই ট্রেন যাত্রার স্মৃতি আজ অনেকের মনেই আছে।

এই ট্রেন যাত্রা আসলে, যতটা না গন্ত্যব্যে পৌঁছনোর তাগিদ, তার চেয়েও বেশি জীবনের পথ চলার এক অভিজ্ঞতা।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Asia, India, Travel and tagged , , . Bookmark the permalink.

1 Response to মিটার গজ ট্রেনের কথা (Metre-gauge railway)

  1. sajal patra বলেছেন:

    Thanks for this wonderfull article. It is vert usefull free net tips for us. Keep Sharing

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s