দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে সোনা দিয়ে ঠাসা এক ট্রেন দিনে দুপুরে হারিয়ে গেল? যা কিনা আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি? তা কি করে হয়? এক জলজ্যান্ত সোনা ভর্তি ট্রেন পৃথিবীর বুক থেকে গায়েব হয়ে গেল? তাও আবার ইউরোপ থেকে?
গুপ্তধন শিকারি ও মিডিয়ার কাছে এর চেয়ে চাঞ্চল্যকর খবর আর বোধহয় হতে পারে না। তাই সারা পৃথিবীর মিডিয়া ও গুপ্তধন শিকারিরা সেই হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় ও মূল্যবান ট্রেনটির খোঁজ শুরু করেছিল।
পৃথিবীর নানা দিক থেকে, টুরিস্ট থেকে শুরু করে, গুপ্তধন শিকারি ও মিডিয়ার মানুষ, পোল্যান্ডের ছোট এক শহর Wałbrzych এ গিয়ে ঐ ট্রেনের খোঁজ করতে শুরু করেছিল।
১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষের দিকের দিন গুলোয়, জার্মানির নাৎসি বাহিনী তাদের অধিকৃত দেশ গুলো্র ব্যঙ্ক ও স্থানীয় ইহুদী মানুষদের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস পত্র, সোনাদানা, কারেন্সি ইত্যাদি লুটপাট করে নিজেদের আখের খুব দ্রুত গুছিয়ে নিচ্ছিল – ঘটনাটা সেই সময়ের।
আবার এদিকে, সোভিয়েতের রেড আর্মি অতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল, হিটলারের নাৎসি বাহিনী তখন একেবারেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।
তাই, পোল্যান্ডের ব্যঙ্ক ও ইহুদী মানুষদের কাছ থেকে লুট পাট করা সমস্ত সম্পত্তি, নাৎসিরা এক ট্রেনে ভরে দিয়ে, বার্লিনের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, সেই ট্রেনের খবর কি ভাবে যেন রেড আর্মি জেনে গিয়েছিল। আর রেড আর্মির হাত থেকে সোনা ভর্তি সেই ট্রেনটিকে বাঁচানোর জন্যে, নাৎসিরা পথেই পাহাড়ের খাদে, মাটির অনেক নিচে গোপন ও সুরক্ষিত এক টানেলের মধ্যে লুকিয়ে দিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষের দিকে, পোল্যান্ড থেকে রওনা দেওয়া, ঐ সোনা ভর্তি ট্রেন বার্লিনে আর পৌঁছয় নি। পথেই সেই ট্রেন গায়েব হয়ে গিয়েছিল। রেড আর্মিও তা খুঁজে পায় নি।
বলা হয়, পোল্যান্ডের ছোট্ট শহর Wałbrzych , যা আগে নাৎসি জার্মানির অধীনে ছিল। সেই Wałbrzych শহর থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের গায়ে ও মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুড়ে হিটলারের জন্যে বাঙ্কার তৈরি হয়েছিল।
শোণা যায়, নাৎসি জার্মানির সবচেয়ে গোপন ও সুরক্ষিত জায়গা ছিল ঐ বাঙ্কার ও তার আশেপাশের এলাকা। কারণ, পাহাড় ও জঙ্গল দিয়ে ঐ জায়গার স্বাভাবিক গঠনটাই অনেক সুরক্ষিত ছিল। আর, আমেরিকা কিংবা মিত্র বাহিনীর বোমাও এই জায়গার যেন কোন ক্ষতি করতে না পারে – তাই, খুবই মজবুত ভাবে মাটির নিচের এই বাঙ্কার তৈরি হয়েছিল। আর সেই সুড়ঙ্গ গুলোর মধ্যে চলে গিয়েছিল ট্রেন লাইন। অনুমান করা হয়, আজও ঐ গোপন বাঙ্কারে নাৎসিদের সেই সোনা ভর্তি ট্রেন লুকিয়ে আছে।
তারপর তো, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু, নাৎসি বাহিনীর সেই রহস্যময় সোনা ভর্তি ট্রেনের কথা আজও পোল্যান্ডের মানুষের মুখে মুখে গল্প হয়ে ফেরে। পোল্যান্ডের মানুষের বিশ্বাসে, কল্পনায় জায়গা করে নেয় ঐ রহস্যময় সোনার ট্রেন। স্থানীয় কিংবদন্তী হয়ে যায় ঐ গোল্ড ট্রেন। এমনকি, স্থানীয় গানেও জায়গা করে নেয় ঐ গোল্ড ট্রেন।
আর অনেকেই গুপ্তধনর খোঁজে, পোল্যান্ডের ঐ গ্রামে, পাহাড়ের এক টানেলের ভেতরে, যেখানে ট্রেনটি হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোণা যায় – সেখানে ভিড় করে। এমনকি পোল্যান্ডের সরকারও সেই ট্রেনের কথা বিশ্বাস করে আর্মি দিয়ে সেই জায়গা খুঁজে দেখেছে।
আবার অনেকেই দাবি করে, সে অত্যাধুনিক টেকনোলোজির সাহায্যে ঐ ট্রেন খুঁজে পেয়েছে। রেডার দিয়ে মাটির নিচে ঐ ট্রেনের উপস্থিতির আভাস পাওয়া গেছে। অনেকে, তো আবার ঐ জায়গার মডেল বানিয়ে, কি ভাবে, এক ট্রেন ঐ জায়গায় এসে গায়েব হয়ে যেতে পারে, তার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে।
কেউ কেউ আবার দাবিও করেছে – তারা ঐ গোল্ড ট্রেন পেয়ে গেছে। কিন্তু, সব প্রচেষ্টই অবশেষে বিফলে গেছে। বাস্তবে, ঐ ট্রেনের কোন অস্ত্বিত্ব পাওয়া যায় নি। কিন্তু, পোলিশরা বিশ্বাস করে – এক দিন ঠিকই গোল্ড ট্রেন খুঁজে পাওয়া যাবে।
যদিও, সেই গোল্ড ট্রেন খুঁজে পাওয়া যায় নি, কিন্তু, ছোট্ট ঐ পোলিশ শহরের মানুষের জন্যে ঐ কিংবদন্তী ট্রেনের গল্প সত্যিই সোনা নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর নানা দিক থেকে, যখন মানুষ ঐ গোল্ড ট্রেনের খোঁজে ঐ ছোট পোলিশ শহরে যায় – স্বভাবতই ঐ শহরের ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির পালে হাওয়া লাগে। সামারের সময়ে, ঐ শহরের প্রায় প্রতিটি হোটেল, রেস্টুরেন্ট মানুষের ভিড়ে জমজমাট হয়ে যায়। সামারে হোটেল গুলোতে জায়গা পাওয়াই মুশকিল হয়ে যায়।
ঐ গোল্ড ট্রেনের কিংবদন্তীকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় ব্যবসা বানিজ্য, জীবিকা, জীবনধারণ, হোটেল ইন্ডাস্ট্রি, গোল্ড ট্রেনের সুভেনিরের দোকান, স্থানীয় অর্থনৈতিক উত্থান – তাই হয়তো স্থানীয়রা চায়, গোল্ড ট্রেন খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক, গোল্ড ট্রেনের কিংবদন্তীটি বেঁচে থাকুক। ঐ কিংবদন্তীই তো সোনা নিয়ে আসছে।