বিজ্ঞানী Fessenden রেডিও ওয়েভে কি ভাবে কথা ও মিউজিক বসানো যায় সে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, এবং জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির Ernst Alexanderson এর সাহায্যে সেই কাজে সফল হয়েছিলেন। Alexanderson এক ইলেকট্রিক জেনারেটর তৈরি করেছিলেন – যে জেনারেটর শুধু যে ইলেক্ট্রিসিটিই উৎপন্ন করতো তা নয়, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভও তৈরি করতো, যা ওয়ারলেস টেলিগ্রাফ সিস্টেমে ব্যবহার হতো – সেই জেনারেটরকে Alexanderson alternator বলা হয়।
Fessenden কার্বন মাইক্রোফোন ব্যবহার করে তার গলার আওয়াজ ও মিউজিককে রেডিও ওয়েভে বসিয়ে দিয়ে অডিও সিগন্যালে পরিণত করে ট্রান্সমিশন করেছিল, তার এই ট্রান্সমিশন পদ্ধতিকে এমপ্লিটিউড মডুলেশন (AM) বলা হয়। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে Fessenden এর সেই ক্রিসমাস ইভের সঙ্গীত প্রসারণ, সমগ্র পৃথিবীর কাছে প্রসারণের এক নতুন দরজা খুলে দিল বলা যায়।
তার মানে, কোন এক জায়গা থেকে সিগন্যাল সম্প্রসারণ করা হবে, সিগন্যাল ব্রডকাস্ট হবে ও যে কেউই সেই সম্প্রসারণ শুনতে পারবে, রিসিভ করবে – আর সেই আইডিয়া থেকেই ‘রেডিও’ র জন্ম হল। সুচনা হল কমুনিকেশনের নবযুগ।
আর রেডিওর এই জন্মগাঁথায় দেখা যায়, পৃথিবীর নানা কোণের বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ি, নানা দেশ এক সঙ্গে কাজ করেছিল – কমুনেকেশনের ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে বড় কোলাবরেশন। আর সেই দীর্ঘ সময়ের গবেষণা মার্কনিকে পথ দেখিয়েছিল। ওদের সবার কাজের উপসংহার দিয়েছিল মার্কনি।
আর ঠিক সেই সময়, আমাদের দেশের বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুও রেডিও সিগন্যাল নিয়ে কাজ করে চলেছিলেন। তিনি, সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে রেডিও সিগন্যাল সনাক্ত করার কাজে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিলেন, কিন্তু, তার আবিস্কারকে বানিজ্যিকরণ করতে চান নি।
যাইহোক, পশ্চিমের কাছে রেডিও ততদিনে আর বিজ্ঞানের গবেষণা হয়ে রইল না – রাতারাতি, রেডিও হয়ে গেল এক ব্যবসা, প্রচুর অর্থ উপার্জনের এক কর্পোরেশন। তাই, রেডিও ও তার আবিষ্কারক নিয়ে রেষারেষি তো থাকবেই। আর সেই যুগের মানুষ এক শক্তিশালী যোগাযোগ মাধ্যমের অভ্যুথানের সাক্ষী হয়ে রইল।
যখন রেডিওর জন্ম হল – কেউ কেউ ভেবেছিল – এক আশ্চর্য জাদু, কেউ ভেবেছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের এক আশ্চর্য অবদান। রেডিও যেন সে সময়ে মানুষের চিন্তার, বিনোদনের দুনিয়ায় এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল।
সেই সময়ে আমেরিকার মানুষ রেডিওকে বিনোদনের জন্যে, তথ্যের জন্যে, ধর্মের প্রচারের জন্যে বিশ্বাস করেছিল, তার আশেপাশে কি ঘটে চলেছে তা জানার জন্যে বিশ্বাস করেছিল – বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, কিছুদিন আগেও পৃথিবীতে যার কোন অস্ত্বিত্ব ছিল না, সেই রেডিও যন্ত্রটি আমেরিকার জীবন যাপনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
সেই সময়ে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টই রেডিওর মত এক ছোট যন্ত্রের ক্ষমতাকে বুঝতে পেরেছিলেন। আমেরিকার সবচেয়ে অন্ধকার সময়, গ্রেট ইকোনমিক ডিপ্রেশনের সময়ে, রুজভেল্ট সর্বদাই রেডিওর মধ্যমে আমেরিকানদের ভরসা দিয়ে চলেছিলেন, সাহস জুগিয়ে চলেছিলেন।
তারপর একচল্লিশের ডিসেম্বরের সেই দিন, সমস্ত আমেরিকান যখন রেডিওতে রুজভেল্টের গলা শোনার জন্যে রেডিওর সামনে বসেছিল – রুজভেল্ট জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ যেন রেডিও ইন্ডাস্ট্রির পালে হাওয়া দিয়েছিল। সেই সময়ে রেডিও সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছিল। যুদ্ধের সরাসরি সংবাদ দিতে রেডিও ছিল সর্বপ্রথম। তাছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে প্রোপ্যাগান্ডা মেশিন হিসাবে রেডিও ব্যবহার হত। সেই সময়ে শুধু যুদ্ধের প্রোপ্যাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে প্রচুর রেডিও ব্রডকাস্টিং সেন্টার তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
আর, নাৎসি প্রোপ্যাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে হিটলার রেডিওকে যতটা ব্যবহার করতে পেরেছিল, তা বোধহয় অন্য কেউই করতে পারে নি। হিটলারের ডানহাত, জোসেফ গোয়েবেলস নাৎসি পার্টির বিজ্ঞাপনের জন্যে, ইউরোপকে দখল করার জন্যে রেডিওকে খুবই ভাল ভাবে ব্যবহার করেছিল। সেই সময়, নাৎসিরা প্রচুর শস্তার রেডিও তৈরি করে জার্মানদের জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঘরে ঘরে উপহার দিয়েছিল। রেডিও না থাকলে হয়তো নাৎসি জার্মানির জন্মই হত না। নাৎসি পার্টির উত্থানও হত না।
রেডিও – ঐ যন্ত্র, যা মানুষের ঘরে ঘরে এক সময় শোভা পেত, তা আজ ইতিহাস, কিন্তু, মানুষের যোগাযোগের, কমুনিকেশনের, দেশের সামাজিক ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রেখেছিল ঐ ছোট রেডিও, তা হয়তো মানুষ আজও ভোলে নি।
—————————————————- শেষ——————————————————————————