এক যাযাবর লক্ষ্যবিহীন – এগারো

বড় গল্প – দশ

Beaux Villages de France (5)

একটু নড়েচড়ে বসে, দূরে দৃষ্টি রেখে, একটু যেন আনমনা হয়ে, শার্লট জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা, ওরা নিজের দেশ বাড়ি ঘর, আত্মীয়, পরিবার, পরিজন সব ছেড়ে কেনই বা চলে আসে এই দেশে?

ফিলিপ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে, এক মুখ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল – দেখো, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে ইউরোপের জনসংখ্যা খুবই কমে যায় – প্রচুর মানুষ যুদ্ধে মারা যায়, আহত হয়।

আর রাস্তা ঘাট, ইমারত, বাড়িঘর, স্থাপত্য সব ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে, আবার নতুন করে তৈরি করার জন্যে প্রচুর শ্রমিক মজুরের দরকার পড়ে। তখন, তৃতীয় বিশ্ব থেকে অনেক শ্রমিক আইনি ভাবেই এই দেশে নিয়ে আসা হয়েছিল, ওরা অনেক সস্তায় কাজ করে দিত। তখন, নানান কন্সট্রাকশন কোম্পানি বিদেশী শ্রমিকদের দিয়ে ইউরোপে অনেক সস্তায় কাজ করাতো।

তখন, নানান কন্সট্রাকশন কোম্পানির কাছে, বিদেশী মজুরদের দিয়ে কাজ করানোর আইনি অধিকার ছিল । বিদেশী মজুররা এখানের মুদ্রায় উপার্জন করতো, আর ছুটিতে দেশে ফিরে গিয়ে ইউরোপের ঐশ্বর্যের গল্প শোনাত, চাকরির গল্প শোনাত।

তারপর, যখন ইউরোপের সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ শেষ হয়ে গেল, একসঙ্গে অনেকের চাকরি চলে গেল। শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে গেল এখানে।

কিন্তু, যারা এসেছিল তারা আর তাঁদের দেশে ফিরে যেতে চাইল না, বরং তারা তাঁদের পরিবারকে এখানে নিয়ে এসে, ততোদিনে এখানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে, শিকড় গেড়ে দিয়েছে এই দেশের মাটিতে। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্য, স্কুলের শিক্ষা, বেকারত্বের দ্বায়িত্ব পড়ল এখানের সরকারের উপরে।

হয়তো, এতদিন পরে ওরা ওদের নিজের দেশে ফিরে গেলেও, ওরা আর চাকরি পেত না। ওদের বয়স হয়ে গিয়েছিল। তারপর তো আইনত ইউরোপে লেবার ইমিগ্রেশন বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু চোরা পথে চলতে লাগল অবৈধ অনুপ্রবেশ – বলা যায় অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেড়ে যেতে শুরু করল।

আমরা বোধহয় চাইলেও এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর স্রোত বন্ধও করতে পারবো না। এরা এখানে আশ্রয় পাওয়ার জন্যে, যতটুকু পারে মিথ্যা কথা বলে, নিজের দেশের আজব অত্যাচারের কথা বলে। অনেক ক্ষেত্রে ওদের কোন কথাই সত্যি নয়।

ভালোই হয়েছে লোকটা কোন কথা বলছে না। বললেও, তো সেই মিথ্যা কথাই বলবে। বানিয়ে বানিয়ে এমন সব আজব গল্প শোনাবে, সাসপেন্স থ্রিলারকেও হার মানাবে। ছাড়ো ঐসব ব্যাপার। চল আজ পাবে যাই। একটু আনন্দ করি, ডান্স করি।’ – ফিলিপ নিঃস্পৃহ স্বরে বলল।

শার্লট বলল – হ্যাঁ ঠিক আছে। চল, তবে আগে বাড়ীতে গিয়ে একটু ফ্রেশ হতে হবে।’

ছুটির রাত গুলো এখানে রঙিন, মুক্ত, উদার, জীবন্ত। রেস্তরাঁর ভিড়, আর ফুরফুরে ফরাসী সুগন্ধি আর ফ্রেঞ্চ ওয়াইনের মৃদু গন্ধে নিশ্চিন্ত রাত এখানে মাদকতা ছড়ায়। অজানা এক আবেশে, ঘোরের বশে ওয়াইনের গোল গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ায় যুবক যুবতীরা। রাত বাড়তে থাকে। পাবের সঙ্গীতের তালে তালে ওদের নাচের ছন্দও ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়।

শীতের কুয়াশা, আরও ঘন হয়ে জমাট বাঁধে, এই ছোট্ট শহরের উপরে এক শীতের শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দেয় – কুয়াশারা থমকে থাকে সারাটা রাত ধরে। ভোরের অপেক্ষায় থাকে এই ছোট্ট শহর ও তার মানুষ। তার যে আরও অনেক গল্প বলার বাকি, শোণার বাকি।

চলবে

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Fiction and tagged , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান