নদীটির ঐ পাড়ে এক অন্য পৃথিবী (The Republic of Užupis, Vilnius, Lithuania)

ছোট্ট এক নদী, আবার নদী বলতে যা বোঝায় এ যেন ঠিক সেই রকম নদীও নয়, তাই মনে হয় নদী বললেও ভুল বলা হবে।

এক পাহাড়ি ঝর্ণার মত দ্রুত গতির এক জলস্রোত, যার নাম Vilnia  নদী, সেই নদী বয়ে গেছে ঐতিহাসিক ভিলিনুস শহরের এক প্রান্তে – আর একটা লোহার সেতু সেই ছোট্ট নদীর ঐ পাড়ের সঙ্গে মূল ভিলিনুস শহরের যোগাযোগ ধরে রেখেছে। আর লোহার সেই সেতুর গায়ে যথারীতি ভালোবাসার তালা ঝোলানো – ইউরোপের যে কোন সেতুর গায়ে যা এক সাধারণ দৃশ্য।

আর ঐ ছোট্ট সেতুটি পেড়িয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে জনবসতির দিকে – তা নাকি ভিলিনুস শহরের বুকে এক স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রে মাত্র সাত হাজার লোকের বসবাস, তার মধ্যে প্রায় হাজার মানুষই পেশায় ও নেশায় শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক। তাই ভিলিনুসের এই জায়গাটিকে প্যারিসের Montmartre এলাকার সঙ্গেও তুলনা করা হয়।

কিন্তু, এই ছোট্ট জায়গাটিকে ভিলিনুস শহরের মধ্যে কেন আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে, টুরিস্ট গন্ত্যব্য তালিকায় যোগ করা হয়েছে – তার কারণ এই জায়গার স্বাধীনতা।

ষোল শতাব্দীতে এই জায়গায় ইহুদীদের বসবাস ছিল, কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে, হলোকোস্টে এই জায়গার এক জন ইহুদীও বাঁচে নি। তারপর ভিলিনুসে, সোভিয়েত শাসনের সময়েও এই জায়গা পরিত্যক্তই ছিল, শহরের এক প্রান্তের এই খালি জায়গা ও বাড়ী গুলো ছিল অপরাধীদের দখলে।

তারপর, ধীরে ধীরে ভবঘুরে ও শিল্পীরা এই জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে দেয়। ১৯৯৭ এর এপ্রিল ফুলের দিনে এই জায়গার বাসিন্দারা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ‘Republic of Užupis’ ঘোষণা করে – এমনকি নিজেদের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় পতাকা, মুদ্রা, মন্ত্রী, জাতীয় সঙ্গীত, সৈন্য দল –তৈরি করে। আর এই রাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা মাত্র এগারো কিংবা বারো জন – ভাবা যায়! বর্তমানে এই জায়গা ভিলিনুস শহরের মধ্যে থেকেও স্বাধীন।

প্রতি বছর Užupis Day, মানে এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। আর সেই দিনটিও এপ্রিল ফুলের দিন ((April Fools’ Day), আর সেটা নাকি মোটেও কাকতালীয় নয় – অনেক ভেবেই এই দিনটিকে এই স্বাধীন রাষ্ট্রের বাসিন্দারা স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছিল। হয়তো, এই রাষ্ট্রের ইতিহাসে একটু কৌতুকের ছোঁয়া দিতেই এই ব্যবস্থা। আর এই ছোট্ট রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধানেও সেই কৌতুকের ছোঁয়া দেখা যায়- যেমন – Man has the right to individuality। কিংবা People have the right to live by the River Vilnelė, while the River Vilnelė has the right to flow past people বা People have the right to be happy ইত্যাদি আরও কতো।

আর সেই এক সকালে, অচেনা ভিনদেশের এক অচেনা নির্জন পথে, এক ঐতিহাসিক শহরের জন মানবহীন নির্জনতায় যখন নিজেদেরকে পাই – আমাদের সব পরিচয় পেছনে রয়ে যায় – দেশ, ধর্ম, জাতি, গোত্র, চামড়ার রং সব সব কিছু পেছনে পড়ে থাকে। আমাদের এক মাত্র পরিচয় হয় মানুষ, ধর্ম হয় মানবতা, মনুষ্যত্ব। সেই মুহূর্তে সামনের অচেনা পথ জিজ্ঞেস করার জন্যে আমরা একটা ভারতীয়, বা স্বধর্মের মানুষ খুঁজে ফিরি না। খুঁজি যে কোন এক মানুষ, যাকে আমরা পথের দিশা জিজ্ঞেস করতে পারবো। আর তখুনি অনুভব হয় – দেশ নয়, জাতি নয়, ধর্ম নয় – ব্যক্তিই বড়। আর সেই কথাটি হয়তো ঐ ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্রের মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Lithuania, Northern-Europe, Travel and tagged , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s