প্যারিসের বুকিনিস্তরা (The Bouquinistes of Paris, France)

সিয়েন নদীর তীরে ছোট সবুজ বাক্সের মতো দোকানে অনেক পুরনো বই, ছবি, পুরনো ষ্ট্যাম্প ইত্যাদি সাজিয়ে যারা বসে – তাঁরাই প্যারিসের বিখ্যাত বুকিনিস্ত। সাধারণত সূর্যদোয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বুকিনিস্তরা তাদের দোকান খুলে রাখে।

প্যারিসের সেইন নদীর দুই তীরে, কখনো ল্যুভরে মিউজিয়াম, বা নত্রে দাম ক্যাথিড্রালের প্রেক্ষাপটে সারি সারি সবুজ বাক্স দেখে কৌতূহল হয়েছিল – কি আছে বাক্সে? আমরা যে সময়েই সিয়েনের তীরে গেছি ঐ বাক্স গুলোকে বন্ধ থাকতেই দেখেছিলাম। শুধু একদিন দেখেছিলাম এক বাক্স খুলে এক বুকিনিস্ত তার পুরনো বই ও ছবি গুলো সাজিয়ে রাখছিল। আর এই বুকিনিস্তদের জন্যেই সিয়েন নদীকে বর্ণনা করা হয় – পৃথিবীর একমাত্র নদী যে কিনা দুই বইয়ের শেল্ফের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে।

সিয়েন নদীর ধারের এই বুকিনিস্ত ও পুরনো বই বিক্রির ইতিহাস প্রায় ষোল শতাব্দীতে শুরু হয়েছিল। তারপর, উনিশ শতাব্দীতে পুরনো বই বিক্রির এক স্থায়ী জায়গা হয়ে যায় সিয়েন নদীর দুই ধার। তারপর বুকিনিস্তদের ঐ সবুজ বাক্স দোকানের আকারও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।

প্যারিসের সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্যে ঐ বুকিনিস্তদের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি যে আসে নি তা নয়, ঐ বাক্স আকারের সবুজ দোকান গুলো সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল অনেক বার – কিন্তু, প্যারিসের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরনো বইয়ের স্মৃতি প্যারিসের মানুষ ঠিক মুছে দিতে চায় নি।

তাই, প্যারিসের সবচেয়ে প্রাচীন, সিয়েন নদীর ধারের তিন কিলোমিটার জায়গা যেখানে ঐ বুকিনিস্তদের সবুজ বাক্স দোকান দেখা যায় – ঐ দোকান ও বুকিনিস্তরা আজ ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত। আজ সিয়েন নদীর তীরের তিন কিলোমিটার জায়গায় দু’শো চল্লিশ জন বুকিনিস্তের প্রায় নয়শোটা সবুজ বাক্স দোকান আছে – সেখানে প্রায় তিন লক্ষ পুরনো বই, জার্নাল, স্ট্যাম্পের সংগ্রহ আছে।

যাইহোক, প্যারিসের সিয়েন নদীর তীরের ঐ বুকিনিস্তরা আজ কেমন আছে? আমার জানা নেই। তবে টুরিস্ট হিসাবে বাইরে থেকে গিয়ে শুধু মনে হয়েছিল – ওরা হয়তো ভালো নেই।

না, ওদের বাক্সের মতো ছোট সবুজ রঙের বাক্স দোকানের দিকে, প্যারিসে বেড়াতে আসা মানুষেরা খুব একটা তাকায় না – প্যারিস মানে আলো, প্যারিস মানে তো নিত্য নতুন ফ্যাশন, ইতিহাস, বড় বড় স্থাপত্য, আর সেই বড় শহরের আলো ও জাঁক জমকের পাশাপাশি এই ছোট ছোট বাক্সের মতো দোকান গুলোর দিকে দেখার সময়, কার কাছে আছে?

আর সেই কথা জেনেই বোধহয় প্যারিসের বুকিনিস্তরা তাদের দোকান বছরের বেশীর ভাগ সময়ই বন্ধ রাখে – অন্তত আমরা খোলা দেখি নি। আর শুনেছি, সামারে দিন ভালো থাকলে, উজ্জ্বল থাকলে, গাছের ছায়ায়, সেইন নদীর পাশে যারা তাদের ছোট বাক্স দোকান খুলে বসে – সারাদিনে বিক্রি বোধহয় হয়ই না। তবুই যেন সময় কাটাতে, পথচারী মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা দেখতেই কেউ কেউ তাদের দোকান খুলে বসে।

সত্যি কথা বলতে – আজকের আধুনিক নিত্য নতুনের সময়ে কেউই পুরনো জিনিসের প্রতি সদয় হতে পারে না। তবুও ওরা পুরনো ম্যাগাজিন, বই, পুরনো কমিকস, পুরনো ছবি ইত্যাদি সাজিয়ে সিয়েন নদীর ধারে সাজানো সারি সারি ঐ ছোট সবুজ বাক্সের মতো দোকান গুলো খুলে বসে। যদি কেউ কোন এক পুরনো দুর্মূল্য ছবি কিংবা স্ট্যাম্পের খোঁজে, কিংবা কোন এক পুরনো বইয়ের খোঁজে, পুরনো বইয়ের পাতায় হারিয়ে যাওয়া এক স্মৃতির খোঁজে ওদের কাছে যায় – সেই আশাতেই প্যারিসের বুকিনিস্তরা পথ দেখে। আর প্যারিসের বুকিনিস্তরা প্যারিসের অঙ্গ, প্যারিসের জীবন যাপনের, ধারণের অঙ্গ, ইতিহাসের অঙ্গ, ছবির অঙ্গ। তাই প্যারিসের ছবির ফ্রেমে বুকিনিস্ত ও ওদের সবুজ বাক্স-দোকানরা ঠিকই জায়গা করে নেয়।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel, Western-Europe and tagged , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান