মধ্যযুগীয় ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্সে, গথিক যুগের তৈরি স্থাপত্য গুলোর মধ্যে এক আশ্চর্য সুন্দর বৈশিষ্ট্য হল – গোলাকার জানালা, গথিক জানালা কিংবা রোজ উইন্ডো। বলা যায় – গথিক যুগের এক মহান সৃষ্টি এই গোলাকার জানালা, আর এই আশ্চর্য সুন্দর গোলাকার জানালার জন্মস্থান ছিল ফ্রান্স – তারপর ধীরে ধীরে মধ্যযুগে এই গথিক জানালা তার নিজের রঙিন কাঁচের সৌন্দর্য নিয়ে সারা ইউরোপ জয় করে নিয়েছিল।
আর যথারীতি সেই গথিক জানালার আশ্চর্য ভ্রমণ কাহিনী ও মধ্যযুগীয় ইউরোপিয়ান সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন অবশ্যই ইউরোপের ক্যাথিড্রাল গুলো কিংবা কোন প্রাচীন প্রাসাদ আজও বহন করে – যা দেখে আজও মানুষ আশ্চর্য হতে ভালোবাসে।
আর এই গোলাকার জানালার রঙিন কাঁচ গুলো যেন এই গথিক যুগের রঙিন গল্পের আরও আকর্ষণীয় এক অধ্যায় – ইউরোপের ইতিহাসের নানা ধর্মীয়, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন সহ্য করেও আজও গথিক জানালার ভঙ্গুর কাঁচ গুলো যে সময়কে অতিক্রম করে আজও বেঁচে আছে – সেটা আরও বেশী আশ্চর্যের।
গথিক জানালা বা রোজ উইন্ডো মানে – রঙিন কাঁচ দিয়ে তৈরি বিশাল গোলাকার জানালা, যে জানালা সাধারণত ক্যাথিড্রালের প্রধান দরজা কিংবা পাশের দরজার উপরে কিংবা দেওয়ালে দেখা যায়। আর সেই গোলাকার জানালায় লাগানো নানা রঙের রঙিন কাঁচের মধ্য দিয়ে যখন সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে ক্যাথিড্রালের ভেতরে ঢোকে – এক অদ্ভুত রঙিন আলো ছায়ার ম্যাজিক তৈরি হয়। মনে হয়, যেন সূর্যের আলোর সাত রংয়ের গহন রহস্য ঐ গথিক রোজ উইন্ডোর মধ্যেই নিহিত আছে। আর সেই গথিক জানালা যেন ঠিক যেন এক সাধারণ জানালা নয় – এক টুকরো শিল্প – মধ্যযুগীয় ফরাসী শিল্প মনস্কতার এক আশ্চর্য নমুনা – কিংবা অপূর্ব এই রোজ উইন্ডো গুলোকে মধ্যযুগীয় গথিক শিল্পের এক একটি মাস্টারপিসও বলা যেতে পারে।
প্যারিসের নত্রে দাম ক্যাথিড্রালে, সকালের প্রথম সূর্যের আলো যখন রোজ উইন্ড দিয়ে ভেতরে ঢোকে, সেই নানা রঙের আলোর বিচ্ছুরণ যেন ভেতরে এক অদ্ভুত ম্যাজিক তৈরি করে, অনেকটা ঠিক kaleidoscope এর মধ্যে চোখ রাখলে যেমন রঙিন আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় – ঠিক তেমনি।
গোলাকার সেই রঙিন জানালা গুলো যেন প্রকৃতির এক পবিত্র সম্পূর্ণতার কথা বলে। শোণা যায়, ফ্রান্সের কোন কোন ক্যাথিড্রালের গায়ে রোজ উইন্ডোর বয়স অনায়াসে চারশো বা পাঁচশো বছর ছাড়িয়ে গেছে – আর বারো, তেরো কিংবা ষোল শতাব্দীর তৈরি সেই সব রোজ উইন্ডো গুলোর গঠন শৈলী, রঙিন কাঁচের কারুকার্য, সবই আশ্চর্য জনক ভাবে সুন্দর, নিখুঁত, সুক্ষ – যা দেখে আশ্চর্য তো হতেই হয়।
শুনেছি, ইউরোপে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা নিজেদের জীবনের বহু সময় বা সারা জীবন ধরেই ইউরোপের ক্যাথিড্রাল গুলোর গায়ের সেই রোজ উইন্ডো গুলোর ছবি তুলে গেছে – শুধু মুদ্ধতার বশেই সেই ছবি তোলার নেশা চেপে গিয়েছিল ওদের মনে।
এক সাধারণ চক্রের মতো গোলাকার জানালায় রঙিন কাঁচ ও আলো দিয়ে ক্যাথিড্রালের ভেতরে যে এক অপূর্ব নাটকীয় পরিবেশ তৈরি করা যেতে পারে – সে না দেখলে যেন বিশ্বাস হয় না। দূর থেকে ঐ রোজ উইন্ডো গুলো দেখলে মনে হয় – এক গথিক আলপনা, কেউ কেউ বলে এই বিশাল গোলাকার জানালা গোলাপের মত একের পর এক পাপড়ি মেলে ধরেছে – তাই নাম হয়েছে রোজ উইন্ডো।
দীর্ঘ দিন ধরে ইউরোপের বুকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, দুর্যোগ, ধ্বংস ও যুদ্ধের মধ্যে এই গথিক রোজ উইন্ডোর ভঙ্গুর কাঁচের স্থায়িত্বের পথ যে খুব সহজ ছিল তা নয় – কখনও মানুষ, কখনো প্রকৃতি এই গথিক রোজ উইন্ডোর কাঁচ ভেঙ্গেছিল – কিন্তু, ইউরোপের মানুষ এই প্রাচীন গথিক শিল্পের প্রতি ভালোবাসার দরুন, সেই প্রাচীন শিল্পকে ফিরিয়ে আনার জন্যে বহু অধ্যবসায় করেছিল – কখনো কখনো এক একটি ভাঙ্গা রোজ উইন্ডোর পুরনো রূপ ফিরিয়ে আনতে তাদের দীর্ঘ সময়ও লেগেছিল।
আলো, রঙিন কাঁচ ও শিল্পের এই অপূর্ব সমন্বয় ওদের মুগ্ধ করেছিল। মধ্য যুগে মানুষের বিশ্বাস ছিল – ঐ বিশাল রোজ উইন্ডো দিয়ে আসা সূর্যের আলো, স্বর্গীয় এক পবিত্র আলোর সরূপ।
আবার কখনো এই রোজ উইন্ডোকে জীবনের রূপক হিসাবেও দেখা হয় – যেমন, রোজ উইন্ডোর কেন্দ্রে যে গোলাকার কাঁচ দেখা যায় – তা হল বর্তমান মুহূর্ত। আর সেই কেন্দ্রকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একের পর এক গোলাকার কাঁচ ও অবয়ব বা গোলাপের পাপড়ির মতো ছড়ানো স্থাপত্য – সেই বর্তমান মুহূর্তের অসীমতাকে বোঝাচ্ছে। আবার কখনও সেই রঙিন কাঁচ ও গথিক রোজ উইন্ডোকে দেখে মনে হতে পারে মধ্যযুগীয় এক বিমূর্ত শিল্পের রূপ। হোক না কয়েকশো বছরের পুরনো শিল্প – আজও কিন্তু ইউরোপের ক্যাথিড্রালের গায়ে ঐ আশ্চর্য সুন্দর রোজ উইন্ডো মানুষকে মুগ্ধ করে, ভাবায়।
আজও ইউরোপের অনেক মানুষ, নানা কারণে বহু ক্যাথিড্রালের ভেঙ্গে যাওয়া রোজ উইন্ডোকে জোড়া দেওয়ার কাজ করে যেতে ভালোবাসে – যাতে ওদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রাচীন গথিক শিল্পের আশ্চর্য সৌন্দর্যকে দেখতে পায় – সেই চেষ্টাই করে। এমনকি, শোণা যায় ইউরোপের বহু আধুনিক শিল্পের প্রেরনাও ছিল গথিক রোজ উইন্ডোর রঙিন কাঁচে আঁকা শিল্প। রোজ উইন্ডো ও তার রঙিন কাঁচ ও আলো আজও যেন মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাকে, স্বপ্ন দেখাকে এক রঙিন রূপ দেয় – সেই রঙিন আলো যেন মানুষকে মুহূর্তেই আনন্দিত করে দিতে পারে।