ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরকে যেন মাকড়সার জালের মতো ইলেকট্রিক ট্রামের তার ও লাইন ঘিরে রেখেছে – ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরের ট্রাম নেটওয়ার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
শহরের মধ্যে চলাচলের জন্যে স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে, বাইরে থেকে আসা আমাদের মতো টুরিস্ট – সবাই ইউরোপের এই চমৎকার ট্রাম নেট ওয়ার্কের উপরে যথেষ্ট নির্ভরশীল। তাই, ইউরোপের শহর গুলোতে পৌঁছে চব্বিশ ঘণ্টার টিকিট কেটে নিয়ে, যখন খুশী সেই ট্রাম গুলোয় যাতায়াত করা যায়।
শুনেছি, উনিশ শতাব্দীতেও ইউরোপের অনেক শহরে, যেমন অষ্ট্রিয়ার অনেক শহরে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলাচল করতো, সেই ঘোড়ায় টানা ট্রাম তো কবেই চলে গেছে, তবে, ইউরোপের কোন কোন শহরে আবার, শুধু টুরিস্টদের জন্যে এখনো ভিন্টেজ ট্রাম চলাচল করে। যেমন লিসবন, পোর্তো, বুদাপেস্ট, ও সুইজারল্যান্ডের বেশ কয়েকটা শহরে টুরিস্টদের জন্যে এখনো ভিন্টেজ ট্রাম চলাচল করতে দেখা যায় – আর সেই ঐতিহাসিক শহর গুলোর ঐতিহাসিক স্থাপত্যের প্রেক্ষাপটে সেই ভিন্টেজ ট্রাম গুলো সত্যিই নজর কেড়ে নেয় – মানানসই এক ছবি তৈরি হয়।
লিসবনের সেই হলুদ ভিন্টেজ ট্রামের ফটো তোলার জন্যে বহু টুরিস্টকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে দেখেছিলাম – বোধহয় লিসবনের সবচেয়ে ফটোজেনিক বস্তু ঐ হলুদ ভিন্টেজ ট্রাম। লিসবনের সেই হলুদ ভিন্টেজ ট্রামে চেপে বসলে দু’পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাত্রা কখন ফুরিয়ে যায়, একদমই বোঝা যায় না।
আবার কোথাও সেই প্রাচীন ট্রামের জায়গা নিয়ে নিয়েছে অত্যাধুনিক ও অপেক্ষাকৃত দ্রুতগামী ট্রাম। নীল, লাল, হলুদ থেকে শুরু করে প্রায় সব বেসিক রঙের ট্রামই ইউরোপের শহর গুলোর রাস্তা দখল করে নেয়।
এক একটি শহরে এক একটি বিশেষ রং প্রাধান্য পায় – যেমন, হেলসিঙ্কির সবুজ ট্রাম তো বিখ্যাত, সেই শহরের রাস্তায় প্রচুর আধুনিক ও প্রাচীন সবুজ ট্রাম মিলেমিশে চলাচল করে।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে, ইউরোপের শহর গুলোয় ট্রামের জনপ্রিয়তা একটু কমে যায়, কিন্তু, বর্তমানে, শহরের ভেতর থেকে অন্যান্য প্রাইভেট যানবাহনের চলাচল কমিয়ে দেওয়ার জন্যে, ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহর প্রাচীন সেই ট্রাম লাইন গুলোকে উন্নত করে, আধুনিক ট্রাম চলাচলের ব্যবস্থা করতে শুরু করে দিয়েছিল বহু আগে থেকেই। যেমন – তুলুসে তো নিজের চোখেই দেখলাম – কি ভাবে অত্যাধুনিক ট্রাম লাইন ধীরে ধীরে শহরের একদম ভেতরে চলে এসেছে।
ভিয়েনার ট্রাম নেটওয়ার্ক পৃথিবী বিখ্যাত নেটওয়ার্ক – ঐটুকু এক শহরের ট্রাম লাইনের নেটওয়ার্ক পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম নেটওয়ার্ক। ঐতিহাসিক ভিয়েনা শহরের প্রেক্ষাপটে চলাচলরত সেই লাল ট্রামও তার নিজস্ব ইতিহাস বহন করে, তাই টুরিস্টদের কাছেও ভিয়েনার ট্রামে চড়ে যাত্রা করা – এক অনন্য অভিজ্ঞতা বলা যায়। কিংবা, ঐতিহাসিক প্রাগের সেই ট্রাম – সেই ট্রাম চেপে বসে যাত্রা করলেই প্রাগ শহরকে অনেকটাই দেখা হয়ে যায়।
অথবা, জাগ্রেবের রাস্তায় মিনিটে মিনিটে চলাচল করা – সেই অত্যাধুনিক ও ঝকঝকে নতুন নীল রঙের ক্রো-ট্রাম! নির্জন রাস্তায়, জাগ্রেবের ঐতিহাসিক ধূসর স্থাপত্য গুলোকে দু’পাশে নিয়ে প্রতিদিন সেই নীল ট্রাম চলাচল করে – ক্রোয়েশিয়ার নিজস্ব সেই ট্রামকে অনেকেই প্রশংসা করে।
আর ইউরোপের নানা শহরে যে বাহন আমাদের চলাফেরায় প্রচুর সাহায্য করেছিল – সেই বাহনকে যে মনে রাখতেই হয় – সেই শহর গুলোয় স্থানীয় ট্রামও যে আমাদের ভ্রমণেরই এক অঙ্গ।