স্মৃতির পাতা থেকে (Toulouse, France)

তুলুসে এসে, প্রথম বিকেলে মিসেস ফণীয়ের আট তলা এপার্টমেন্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে এই ঐতিহাসিক লাল শহরের উপরে রক্তিম সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে,  এই লাল শহরের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সঙ্গে নিজেদেরকে জুড়ে নিতে হবে, ভাবতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল – বড়ই অচেনা ছিল তুলুস ও তার রাস্তা ঘাট। আমাদের নিজস্ব জীবন যাপন, সংস্কৃতি সব কিছু থেকে আলাদা এই শহর ও তার মানুষ – কিছুই প্রায় জানি না, গুগুল ম্যাপ ও উইকিপিডিয়া তুলুস সম্বন্ধে যা বলে – সেই নিয়েই ছিল এই শহরকে জানা ও চেনার পরিধিটুকু।

মিসেস ফণীয়ের সাজানো বেলকনি থেকে দেখা যাচ্ছিল শহরের লাল টালির ছাদের প্রচুর বাড়ী ও ঐতিহাসিক বিল্ডিং গুলো, দূরের চার্চের চূড়ার ঘণ্টাগুলো। তুলুসে প্রথম কয়েকদিন মিসেস ফণীয়ের এপার্টমেন্টের একটি রুম ছিল আমাদের অস্থায়ী বাসস্থান। এই শহরকে চিনে নিতে, আমাদের সাহায্য করার ভার তিনি নিজের ইচ্ছেতেই নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন।

স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ঐ রক্তিম সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে গলার কাছে এক মনখারাপ দলা পাকিয়ে উঠে আসছিল – কিন্তু, বিদেশ বিভূঁইয়ে যখন এক ফরাসী ভদ্রমহিলা নিজের হাতে কফি তৈরি করে, আমাদেরকে হাসিমুখে সার্ভ করে, পাশে এসে দাঁড়ান – ধোঁয়া ওঠা সেই কফির কাপে চুমুক দিয়ে, সেই দলা বাঁধানো মনখারাপটিকে এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলতেই হয় – তাড়াতাড়ি চোখে মুখে এক চিলতে হাসি আঁকতে হয়।

আর তাছাড়া, যে কোন অচেনাকে জানা, অদেখাকে দেখা, আবিষ্কার করে এগিয়ে যাওয়াই তো জীবনের আরেক নাম, বলতে গেলে জীবনের প্রতিটি দিনই তো অচেনা, অজানা – কবি তো বলেইছেন – অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে।

তাই, পরের দিন তুলুসের সমস্ত রাস্তা ঘাট, মেট্রো ষ্টেশন ইত্যাদির টাইমটেবল জেনে নিতে মিসেস ফণীয়ের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বলা যায় – তুলুসের প্রথম সেই দিনে নতুনকে আবিষ্কারের নেশায় ডুবে গিয়েছিলাম। শুরু হয়েছিল এক নতুন ধরণের জীবন। আর সেই সন্ধ্যেয় তুলুসের আকাশ যেন আরও রঙিন হয়ে সাজছিল।

তারপর থেকে তো – প্রতিদিন একটু একটু করে এই লাল-গোলাপি শহরের এ গলি, সে গলি, রাস্তা, উৎসব, অনুষ্ঠান, নদী সব কিছুকেই কি ভাবে যেন ধীরে ধীরে জেনে গিয়েছিলাম – ছন্দটিকে চিনে নিয়েছিলাম। এই শহরের কতো বদলের সাক্ষী হয়ে গিয়েছিলাম, তুলুসে প্রথম ট্রাম চলাচলের সাক্ষী হওয়া থেকে শুরু করে এই শহরের বহু বদল, ও উন্নতির সাক্ষী হয়েছিলাম – বুঝতেই পারি নি, এক সময়ে যে শহরকে আট তলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখে অচেনা বলে মনে হয়েছিল – সেই শহর আমাদের জীবন ধারণের সঙ্গে, বাঁচার সঙ্গে এই ভাবে জুড়ে যাবে, নিজেদের অগ্রগতির সঙ্গে এই লাল শহর জড়িয়ে যাবে – ভাবি নি – সেই মুহূর্তে সত্যিই ভাবি নি। ফরাসী ভাষায় বলা যায় – সে লা ভি (C’est la vie) – প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ে মালা গেঁথে যাওয়ার নামই বোধহয় জীবন।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Western-Europe and tagged , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান