আচ্ছা, সিনাগগটা কোনদিকে বলতে পারো? – প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলাম এক হাঙ্গেরিয়ান যুবককে। নীল টি শার্ট পড়া ছেলেটি, টিশার্টে ‘আই’ আঁকা – মানে ইনফরমেশন।
টুরিস্টদের চলাফেরার সুবিধার জন্যে, জরুরি ইনফরমেশন দেওয়ার জন্যে, বুদাপেস্টের রাস্তার মোড়ে মোড়ে যে সমস্ত ছোট টুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ দেখা যায়, তেমনি এক বুথের সামনে ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করা মাত্র, একটু যেন সংকোচ হল – যতই হোক, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে হাঙ্গেরির ইহুদীদের উপরে অত্যাচারের ইতিহাস তো হাঙ্গেরির এক কালো অধ্যায়, হয়তো এই প্রশ্ন করে ওকে বিব্রত করে ফেললাম, বহু পুরনো কোন এক ক্ষতে আঘাত দিয়ে ফেললাম না তো? কিন্তু, ওর হাসিমুখ দেখে আমাদের সেই সংকোচ নিমেষে উধাও।
ছেলেটি হাসি মুখে তাকিয়ে জবাব দিয়েছিল। ম্যাপে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল – বুদাপেস্টের এই সিনাগগ ইউরোপের সবচেয়ে বড় সিনাগগ, এমনকি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম এই সিনাগগ। ঐতিহাসিক এই সিনাগগ বুদাপেস্টের অন্যতম টুরিস্ট গন্ত্যব্য।
বুঝলাম – বুদাপেস্টের বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়কে নিয়ে মাথা ঘামায় না, ঘামানোও উচিত নয়। ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায়কে মনে রেখে বার বার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, বার বার একই কথা বলা, একই পথে চলা – নতুন প্রজন্ম তথা মানব সভ্যতার এই পরিনতি হতে পারে না।
ছেলেটিকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম – আচ্ছা, শুনেছি তোমাদের শহরেও প্যারিসের “Champs Elysees” এর মত বড় এক রাস্তা আছে?
হাঙ্গেরিয়ান যুবকটির চোখে মুখে আরও উজ্জ্বল এক হাসি জ্বলে উঠেছিল – সে হাসতে হাসতেই হাত তুলে সামনের দীর্ঘ রাস্তাটি দেখিয়ে দিয়ে বলেছিল – হ্যাঁ এই রাস্তাই বুদাপেস্টের “Champs Elysees” হয়তো এই রাস্তা প্যারিসের রাস্তার চেয়ে আরও বেশী সুন্দর – ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে যাও।
দুই ধারে সুন্দর গাছ লাগানো চওড়া সেই রাস্তা সত্যিই বুদাপেস্টের অন্যতম আকর্ষণীয় এক জায়গা – তাছাড়া, বুদাপেস্টের এই রাস্তার দুপাশ, উনিশ ও কুড়ি শতাব্দীর, Eclectic-style এ তৈরি বিল্ডিঙের ঠিকানা, পৃথিবীর যাবতীয় ব্রান্ডের শোরুমের ঠিকানা এই রাজপথ। তাছাড়া, হাঙ্গেরির সমস্ত সুন্দর স্থাপত্য যেন এই রাস্তাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে। যা দেখার জন্যে বুদাপেস্টে এলে মানুষ এখানে আসতে বাধ্য হয়।
প্যারিসের অনুকরণে তৈরি এই রাজপথ, হাঙ্গেরির এক প্রাক্তন প্রাইম মিনিস্টারের এক স্বপ্ন ছিল – তাই তার নামেই এই রাস্তার নামকরণ হয়েছে। দু’হাজার মিটারের উপরে দীর্ঘ এই রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে নানান স্থাপত্য, অলংকৃত হাঙ্গেরিয়ান অপেরা হাউস নজরে পড়ে।
বুদাপেস্টের এই রাস্তার গল্প শুধু যে মাটির উপরেই থেমে যায় তা কিন্তু নয় – এই রাস্তার নীচে, সমান্তরাল ভাবে চলে গেছে, ইউরোপের প্রথম ও প্রাচীন আন্ডারগ্রাউন্ড রেল লাইন – তথা মেট্রো লাইন – সেই মেট্রোর বয়স কবেই একশো ছাড়িয়ে গেছে – যা আজও কার্যকরী।
ইউরোপের প্রাচীনতম মেট্রো লাইন এই রাজপথের নীচ দিয়ে চলে গেছে – তাই এই রাস্তা সহ, মেট্রো লাইন ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টে স্থান পেয়েছে। এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে, মাঝে মাঝেই সেই মেট্রো ষ্টেশনে ঢোকার প্রাচীন দরজা গুলো দেখা যায়।
প্যারিসের রাজপথের মতো নাম ডাক, জাঁকজমক এই রাজপথের না থাকুক, নাই বা থাকুক হাজার টুরিস্টের আনাগোনা, শপিঙের ব্যস্ততা, কোলাহল – কিন্তু, বুদাপেস্টের এই রাজপথ প্যারিসের চেয়ে কোন অংশেই কম যায় না – সত্যিই এই রাজপথকে স্থাপত্যের দিক দিয়ে প্যারিসের রাজপথের সঙ্গে অতি অনায়াসে তুলনা করা যায়।