সম্ভবত সাইকেল চালানোর ইতিহাসে, প্রথম সাইকেল তৈরির সময় থেকেই এই শহরের মানুষ সাইকেল চালিয়ে আসছে – উনিশ শতাব্দীর শেষের দিকে, এই শহরের মানুষ সাইকেলকে আপন করে নিয়েছিল – আর সেই আদিম সাইকেলের গত একশো বছরের বিবর্তনে, সাইকেলের নামকরণ ও আকার Iron Horse থেকে শুরু করে bike, Bicycle, Penny-farthing যাই হোক না কেন, এরা এদের সেই সাইকেল চালানোর অভ্যেস আজও বদলায় নি।
আর ওদের সেই প্রাচীন অভ্যেস, এই শহরে পৌঁছে প্রথমেই অনেকের চোখে পড়ে – গাড়ির সংখ্যার চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা এখানে অনেক বেশী – যত্র তত্র সাইকেলের বাহার, ব্যবহার – এমনকি, সাইকেল চালকরা ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলো দেখলে, গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায় – বোঝা মুশকিল রাস্তার মোড়ে ট্র্যাফিক লাইট গুলো সাইকেলের জন্যে? নাকি গাড়ির জন্যে? সাইকেলও ট্র্যাফিক নিয়ম মেনে চলে?
আর শহরের প্রতিটি রাস্তায় সাইকেলের জন্যে চওড়া রাস্তা তৈরি, যাতে এক সঙ্গে প্রচুর সাইকেল চলাচল করতে পারে – কোন গাড়ি কিন্তু ভুলেও সেই সাইকেল চালকদের রাস্তায় আসে না – এখানে এরা সাইকেল চালানোটা এতটাই গুরুত্ব দেয়।
অক্টোবরের কণকণে ঠাণ্ডায় কি ভাবে দুই হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে সাইকেল চালায় – ভেবেই যেন ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে উঠি। আর যানজটের দেশের মানুষ আমরা, শহরের রাস্তার মোড়ে, যে কোন ধরণের যানবাহন নিয়ে, কোমড় কষে যানজট ও গাড়ির হর্ন দিয়ে দিয়ে কান ঝালাপালা না করলে, আমাদের দিন যে শুরুই করা যায় না – আর সেই আমরা এক রাজধানী শহরের রাস্তায় এক সঙ্গে এতো সাইকেল দেখে আশ্চর্য তো হবোই। শুধু আমরা কেন – শুনেছি পৃথিবীর সবাই এদের এই সাইকেল চালানোর বহর দেখে আশ্চর্য হয়।
বাইরে থেকে যারাই এই শহরে আসে, এদের এই সাইকেল প্রীতি, সাইকেল চালানোর ব্যপারটা ঠিকই নজরে পড়ে। শুনেছি, এই শহরে বড় ব্যাংকের ডিরেক্টর থেকে শুরু করে ডাক্তার, কেরানি, ছাত্র ছাত্রী, নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ীর পুরুষ, মহিলা – এক কথায় বলা যায়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ একই সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাসিমুখে সাইকেল চালিয়ে যায়।
তবে, এই শহরের মানুষদের মধ্যে সাইকেল চালানো বেশ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়েছে – অবশ্য কুড়ির দশকে এখানের লোকেরা সাইকেল চালাতে খুবই ভালোবাসতো – কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ঠিক পরেই এখানের জন জীবন পালটে গিয়েছিল – এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল – যে সময়ে এখানের মানুষ সমস্ত আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল – তখন, সেই পুরনো সাইকেল চলে গিয়েছিল গ্যারাজের এক কোণে, গায়ে জমে উঠছিল ধুলো – সাইকেলের জায়গা নিয়ে নিয়েছিল মোপেট, কার ইত্যাদি। ডেনমার্কে অটো মোবাইল ইন্ডাস্টির পালে লেগেছিল হাওয়া – কিন্তু, ডেনমার্কের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টারা সেই সময় হয়তো, রাজধানী কোপেনহেগেনের রাস্তায় সাইকেল চালকদের দেখে নি, কোন সাইকেল দেখে নি – দেখেছিল, আকাশ ছোঁয়া আধুনিক স্থাপত্য, চওড়া রাস্তায় দামী গাড়ির ভিড় – এক অত্যাধুনিক ঝকঝকে শহরের ছবি – স্মার্ট সিটি।
কিন্তু, সত্তরের দশকের oil crisis যেন সেই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাদের স্বপ্নকে নাড়া দিয়েছিল। সত্তরের দশকের সেই oil crisis এই শহরবাসীকে আবার সাইকেলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল – পুরনো সেই ধুলো ঝাড়ানো সাইকেল আবার এই শহরের রাস্তায় দেখা গিয়েছিল। তখন তেল বাঁচানোর জন্যে শুরু হয়েছিল – Car Free Sundays তারপর সাইকেল চালকরা Car Free Copenhagen এর আন্দোলন শুরু করেছিল – সেই সময় এই শহরের অধিকাংশ মানুষ বড় গাড়ি ছেড়ে, শহরের ভেতরে যাতায়াতের জন্যে সাইকেলকে হাসি মুখে, স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিল। আজ, এই শহরের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ যাতায়াতের জন্যে সাইকেল বেছে নেয় – কেউ কেউ নাকি ঠাণ্ডা, বৃষ্টি ও তুষারপাতেও সাইকেল চালায় – সে অবশ্য অক্টোবরের কণকণে ঠাণ্ডায় ওদের সাইকেল চালানো দেখেই বোঝা যায়।
আজ কোপেনহেগেন শহর কতৃপক্ষ সাইকেল চালকদের জন্যে সুরক্ষিত রাস্তা তৈরির জন্যে প্রচুর ব্যবস্থা নিয়েছে – শহরের সমস্ত রাস্তায় সাইকেল চালকদের গুরুত্ব দিয়ে রাস্তাকে সমান ভাগে ভাগ করে – সাইকেল চালকদের জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোপেনহেগেন মিউনিসিপালিটি, শুধু যে সাইকেল চালকদের জন্যে Infrastructure তৈরি করে দিয়েছে, তাই নয়, সাইকেল চালকরা যাতে নিয়ম মেনে সাইকেল চালায় তার জন্যে, সাইকেল লেন গুলোয় karma-police নিয়োগ করেছে, ওরা দেখে চালকরা সাইকেল চালানোর ডেনিশ কালচার মেনে চলছে কিনা। পরিবেশ দূষণ বিহীন এই বাহনটিকে এরা যথেষ্ট সম্মান করে – আর যারা এই বাহন চালায়, তাদেরকে বড় বড় গাড়ি চালকরাও রাস্তা ছেড়ে দেয়। তাই, এই শহরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সাইকেল ফ্রেন্ডলি শহর বলা হয়।