ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন – এক স্বপ্ন (European Union)

European Union.JPG

সময়টাকে একটু পিছিয়ে দিতে হবে – ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, একটা প্রজন্ম দু’দুটো ভয়াবহ যুদ্ধের পরিনতি দেখে নিয়েছে। আর ইউরোপের প্রতিটি দেশের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় তো একের পর এক যুদ্ধের কথাই লেখা, যা জেনেই সেই সময়ের প্রজন্ম বড় হয়েছিল।

আর সেই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিণতির শিকার ছিল সেই প্রজন্ম। তাই সেই সময়ের চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, সমাজ বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কূটনীতিবিদ ও ব্যবিসায়িক ব্যক্তিত্বরা আগামী প্রজন্মের জন্যে রেখে যাওয়া, যুদ্ধ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিউড়ে উঠেছিলেন।

এই ভাবে নিজেদের ছোট ছোট দেশ গুলোর মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে – তা অনুমান করে ইউরোপের দেশ গুলোকে তারা এক করার চিন্তা শুরু করেছিলেন। ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে স্থায়ী অর্থনীতি, রাজনীতি ও শান্তির এক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা শুরু করেছিলেন।

কিন্ত, সময়টা তখনো ছিল সংবেদনশীল – শুরু হয়ে গিয়েছিল শীতল যুদ্ধ, রাশিয়া ও আমেরিকা যে যুদ্ধের কেন্দ্র ছিল – যার আঁচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের গায়েও লেগেছিল।

কিন্তু, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডের প্রথম সারির রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী ও কূটনীতিবিদ, কৃষক নেতা, এমনকি লুক্সেম্বার্গের মতো ছোট দেশের প্রথম সারির নেতাও ইউরোপের দেশ গুলোকে জুড়ে দেওয়ার সেই স্বপ্নে কিন্তু ইন্ধন যুগিয়ে চলেছিলেন – ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে মুক্ত ও সাধারণ অর্থনীতির চিন্তা করেছিলেন, নেদারল্যান্ডের কৃষক ও ডাচ রেজিস্টেন্সের সদস্য Sicco Mansholt, ইউরোপিয়ান দেশ গুলোর মধ্যে সাধারণ কৃষি নীতি পরিকল্পনা করেছিলেন – যাতে ইউরোপিয়ান দেশ গুলো খাদ্য শস্যের জন্যে নিজেদের উপরে নির্ভরশীল হতে পারে, স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে – সেই সাধারণ কৃষি নীতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শুরুর সেই দিন গুলোর জন্যে সত্যি খুবই দরকারি ছিল।

তারপর, ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল – তিনিও United States of Europe গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ সহমত ছিলেন – তার মতে ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে উগ্র জাতিয়তাবাদ ও যুদ্ধ প্রচারের মনোবৃত্তি দূর করে শান্তির বাতাবরণ ফিরিয়ে আনতে হলে, ইউরোপের সব দেশ গুলোকে এক সঙ্গে দাঁড়াতেই হবে। তাই, সত্তরের দশকে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিল – সে ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্ত, ছিল অনেক স্বপ্ন।

আবার পঞ্চাশ বছর সময়ও অতিক্রান্ত হয়নি – গণতন্ত্রের জোরে ব্রিটেন আলাদা হয়ে যেতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্রিটেনের ভালো হল কি খারাপ হল, সে সময়ই বিচার করবে, কিন্তু, পাউন্ডের দাম যথেষ্ট কমে যাওয়ায় অনেকেই তার পরবর্তী ভ্রমণ তালিকায় ব্রিটেনকে যোগ করে নিয়েছে।

যাইহোক, দেশ তো শুধু মাত্র এক জমির টুকরো নয় – মানুষ নিয়েই দেশ, আর সেই মানুষ গুলোই হয়তো শান্তি ফিরিয়ে আনতে জুড়ে যেতে চেয়েছিল – তাই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মানুষ একসময় এক সঙ্গে মিলে, নোবেল শান্তি পুরষ্কারও পেয়েছিল। ওদের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছিল – একে একে ইউরোপের দেশ গুলো জুড়ে যেতে শুরু করেছিল।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশ গুলোর মধ্যে মুক্ত অর্থনীতি স্থাপিত হয়েছিল – সীমান্ত খুলে গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল মুক্ত যাতায়াত, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সংযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ গুলোর অর্থনীতির পালে লেগেছিল হাওয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ গুলোর মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল সাধারণ মুদ্রা – ইউরো।

তারপর তো একে একে ইউরোপের নানান দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছে – আমাদের চোখের সামনেই কত দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়ে গেল – ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হারজিগভিনিয়া, রোমানিয়া, অ্যালবেনিয়া আরও কতো দেশ। প্রায় দুশো বছর আগে, ফরাসী সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো United States of Europe তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন – আর সেই স্বপ্নের এতোই দৃঢ় দূরদর্শিতা ছিল যে, বিংশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপের দেশ গুলো সত্যিই জুড়ে গিয়েছিল।

ভালো মন্দ, অর্থনৈতিক উত্থান পতন নিয়ে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সময় বয়ে চলেছিল – আর আমাদের মতো বিদেশীদের কাছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ গুলোতে ভ্রমণের জন্যে এই সময়টাকেই অতি উত্তম সময় বলা যায় – সীমান্তের কোন বাঁধা নেই, ভিসা নেই, মুদ্রার কোন ভাঙ্গা গড়া নেই, ওঠা পড়া নেই, শুধু টিকিট কেটে বাসে, ট্রেনে চেপে পড়া – আর রাতে এক দেশ থেকে যাত্রা শুরু করে সকাল হয় অন্য দেশের ষ্টেশনে, কিংবা সকালে বাসে চেপে দুপুর হয় কোন এক অন্য অচিন দেশের শহরে – ভাষা থেকে শুরু করে সংস্কৃতি, মানুষ সবই বদলে যায়। আর এই অবাধ মুক্ত স্বাধীনতার মধ্যেই বোধহয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সার্থকতা – কে জানে? বাকি সবই সময় জানে।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Travel and tagged , , , . Bookmark the permalink.

2 Responses to ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন – এক স্বপ্ন (European Union)

  1. Mohammad Sulaiman Khan বলেছেন:

    Thank for your nice presentation.In fact EU is a symbol of mutual love and friendship. So we are in favor of EU and its continuation.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s