গলন্ত সময় – সালভাদর দালি – দুই (Salvador Dalí Museum, Old Square, Prague, Czech Republic)

তবে, দালির সুর-রিয়েলিজম যে শুধু ক্যানভাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয় – ক্যানভাসের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছিল অনেক পথ, অনেক দূর। দালি সুর-রিয়েলিজমকে বিশ্ব বিখ্যাত করার চেষ্টায় ছিলেন – তাই দালির প্রসারিত সুররিয়েল শিল্প, ইন্টিরিয়র ডিজাইনে যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমনি অত্যাধুনিক ফ্যাশন র‍্যম্পের কাপড়কেও দালি এক সুররিয়েল শিল্পে পরিণত করেছিলেন – এমনকি, আজকের ফ্যাশনের লেডি গাগাও দালির সুর-রিয়েলের সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখে চলেছে। ফ্যাশন দুনিয়ার গহনাতেও দালির শিল্প প্রসারিত হয়েছিল – বলা যায়, দালিই ফ্যাশন ও গহনার দুনিয়াতে উদ্ভট সুর-রিয়েলিজমকে পরিচয় করিয়ে ছিলেন। দালির বিখ্যাত – লবস্টার টেলিফোন রিসিভার, ঠোঁটের মতো দেখতে সোফা ইত্যাদি যেন সুররিয়েল জগতকে বাস্তব রূপ দিয়েছিল। আর দালির তৈরি এই ধরণের সুররিয়েল বস্তু, আধুনিক অন্দরসজ্জার এক নতুন উজ্জ্বল দিক খুলে দিয়েছিল।

তাছাড়া, দালি, তার ছবিতে মানুষের মনের ও চোখের ভুল, ভ্রান্তি, বিভ্রম, অযৌক্তিকতা ইত্যাদিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। দালি, বিশ্বাস করতেন – মানুষের মনের অদ্ভুত, উৎকট, কিম্ভূত বিভ্রমই বাস্তবকে তৈরি করতে সাহায্য করে। আর মানুষের মনের গভীরের সেই অদ্ভুত বিভ্রমকে, বদ্ধ সংস্কারকে, অস্থিরতাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে, রূপ দিতে, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাইকো এনালাইসিস থিয়োরির উপর ভিত্তি করে, এক অদ্ভুত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন – paranoiac-critical method।

যেমন – ধরা যাক, একটা পাথর – সাধারণ চোখে দেখলে মনে হয়, সত্যি একটা পাথর – কিন্তু, একটু অন্যরকম ভাবে, একটু ভুল দৃষ্টিতে দেখলেই দেখা যায় – নাঃ, এ তো সাধারণ পাথর নয়, একটা মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী। অনেক সময় মেঘ দেখলেও এমনি এক ভ্রম হয়, মেঘ দেখে মনে হয় কোন প্রাণী বা নৌকো, বা হাতি, কিংবা পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মনে হয়, চাঁদের মধ্যে এক বুড়ি বসে চরকা কাটছে – এই সবই গহন মনের অদ্ভুত সব ভ্রম – দৃষ্টি ভ্রম।

আর মনের ও চোখের সেই ভ্রম, একই ছবিতে দুই ধরণের ছবি লুকিয়ে থাকার এই আশ্চর্য দৃষ্টি বিভ্রম দালিকে আশ্চর্য ভাবে মুগ্ধ করতো। আমাদের চোখ ও মন কিভাবে প্রকৃতির তথ্যকে ব্যাখ্যা করে, ছবি তৈরি করে, কিভাবে, বিভিন্ন মানুষ পৃথিবীকে বিভিন্ন ভাবে দেখে ও বিচার করে – দালি সে নিয়ে রীতিমত গবেষণা করতেন।  আর দালি, মানুষের সেই দৃষ্টি বিভ্রমকে শুধু মেঘেই সীমিত রাখেন নি, প্রকৃতির পাথর, সমুদ্র, বস্তু ইত্যাদির দিকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

আবার কখনো কখনো দালির মারাত্মক রকমের উদ্ভট সুর-রিয়েল ছবি মানসিক ভাবে অস্থিরও করে দেয় – মানুষের কল্পনাও যেন হার মেনে যায় দালির উদ্ভট অবচেতন মনের শিল্পের কাছে। দালি, তার চূড়ান্ত সুর-রিয়েল শিল্পকে সিনেমার পর্দাতেও প্রসারিত করেছিলেন।

এমনকি, অ্যালফ্রেড হিচকক, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার- Spellbound  চলচিত্রের স্বপ্নের সিকোয়েন্স তৈরির জন্যে, সালভাদর দালি ছাড়া অন্য কারোর কথা ভাবতে পারেন নি।  Spellbound  চলচিত্রেই প্রথম ফ্রয়েডের সাইকো-এনালাইসিস মেথড দেখানো হয়েছিল, যেখানে এই মেথড ব্যবহার করে খুনিকে ধরা হয়েছিল।

হিচককও দালির অদ্ভুত সুররিয়েল দৃশ্য তৈরির নিদর্শন দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন – অদ্ভুত দৃশ্য, বাস্তবের সঙ্গে যার কোন মিল নেই, তবুও মনে হয় বাস্তব, আর সেখানেই দালি দর্শকদের সম্মোহিত করে দিয়েছিলেন – দালি হয়তো সেই জন্যেই আরও আরও বিখ্যাত হয়ে উঠছিলেন।

চলবে

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Czech Republic, Eastern-Europe, Europe, Travel and tagged , , , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান