ভিয়েনার ইতিহাসে মোজার্টের সুর যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি জড়িয়ে আছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনের জটিলতার থিয়োরি। যখনই মানুষের মনের অদ্ভুত বিন্যাস, স্বপ্ন দেখা, মানসিক উদ্বেগ, চেতন ও অবচেতন মনের অদ্ভুত জটিলতার কথা আসে – সবাই ফ্রয়েডের কথা বলে।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞান যখন মানুষের অ্যানাটমি নিয়েই ব্যস্ত ছিল, ফ্রয়েড মানুষের গহন মনের জটিলতার দিকে, মানসিক রোগের দিকে দেখেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগে মনের রোগ সারাতে মানুষ কোন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ভাবতো না – কিন্তু, সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনের রোগীদের এক অদ্ভুত উপায়ে চিকিৎসা করতেন।
সেই সময়, এটা মেনেই চলা হত, চিকিৎসক যা বলবে, রোগী শুনবে – সেটাই শেষ কথা, সেটাই নিয়ম – কিন্তু, ফ্রয়েড রোগীদের জীবনের সমস্ত কথা, রোগীদের মনের গভীরের ভাবনা, চিন্তা – সবই খুব মন দিয়ে শুনতেন। ফ্রয়েডের রোগীদের কথায় ‘talking treatment’, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই নাকি অনেক মানসিক রোগ সেরে যেতো।
এবং, সেই সময়ে ফ্রয়েডের রোগীদের কথা শোণা ও রোগী দেখার পদ্ধতি অদ্ভুত তো ছিলই, সেই সঙ্গে সঙ্গে রোগী দেখে তার নিজস্ব থিয়োরি গুলো ছিল আরও বিদঘুটে, উদ্ভত – যা সেই সময়ে অনেককেই আশ্চর্য করেছিল। চিকিৎসা জগতে, মানুষের অবচেতন মন নিয়ে তার থিয়োরি বিপ্লব এনে দিয়েছিল।
বলা যায়, ফ্রয়েড মানুষের অবচেতন মনের তালা বন্ধ দরজাটির চাবি খুঁজে পেয়েছিলেন, এবং সেই দরজাটি খুলে দিয়ে, চিকিৎসা শাস্ত্রে এক নতুন শাখা যুক্ত করেছিলেন – সাইকোএনালাইসিস।
আবার ফ্রয়েডের এই সাইকোএনালাইসিস ও থিয়োরি, ভিক্টোরিয়ান যুগের ভিয়েনায় যে খুব একটা সমাদর পেয়েছিল তা নয়, আপত্তি উঠেছিল নানা মহল থেকে, নিন্দাও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু, উপকৃত রোগীদের কাছে সমাদরও পেয়েছিল। ফ্রয়েড তার নিজের জীবনেও নিজের সাইকোএনালাইসিস করতেন – মানে, নিজেই নিজের রোগী হতেন।
মানুষের অবচেতন মনের খোঁজ করতে গিয়ে, তিনি ঘুমের ঘোরে ঘুমন্ত মনের অর্থহীন স্বপ্ন দেখাকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন – তার সাইকোএনালাইসিসে তিনি মানুষের অর্থহীন স্বপ্ন দেখাকেও এক বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিচার করতেন। কিন্তু, সেই সময়ের ভিয়েনা তার অদ্ভুত থিয়োরি, অদ্ভুত সাইকোএনালাইসিস মেনে নেয় নি। তবে, সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার যত অদ্ভুত থিয়োরি ও যুক্তিতে অনড় ছিলেন। তাঁকে ও তার থিয়োরিকে ঘিরে ভিয়েনায় এক ছোট্ট সাইকোএনালাইসিস গ্রুপ গঠন হয়েছিল – যারা ফ্রয়েডের কথাকে, থিয়োরিকে বিশ্বাস করতো – তারপর ধীরে ধীরে সেই সাইকোএনালাইসিস গ্রুপের সদস্য সংখ্যা জুরিখ ও নিউইয়র্কেও ছড়িয়ে পড়ে।
তারপর কুড়ি বছর সময়ে, ফ্রয়েড ডজনের উপরে বই, পেপার, প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যে সময়ে ফ্রয়েড মানুষের মনের রহস্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন, ও নিজের ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন – জার্মানিতে উঠে আসছিল নাৎসি পার্টি – ১৯৩৮ এ অষ্ট্রিয়াকে দখল করে নিয়েছিল হিটলারের নাৎসি পার্টি।
এবং ইহুদী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সমস্ত তত্ত্ব, সাইকোএনালাইসিসের থিয়োরিকে নাৎসিরা কড়া ভাষায় নিন্দা করে, ফ্রয়েডের যাবতীয় বই, লেখা, প্রবন্ধ, পেপার সব কিছু পুড়িয়ে দিয়েছিল।
সেই সময় ফ্রয়েডকে বাঁচানোর জন্যে তার শুভানুধ্যায়ীরা ফ্রয়েডকে অষ্ট্রিয়া ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল – কিন্তু, অষ্ট্রিয়ার সঙ্গে ফ্রয়েডের সমগ্র জীবন, কাজ, পরিচয় সবই জড়িয়ে ছিল, ফ্রয়েড কিছুতেই অষ্ট্রিয়া ছেড়ে যেতে চান নি।
কিন্তু, যখন ফ্রয়েডের মেয়ে Anna Freud কে গেস্টাপোরা প্রশ্ন করার জন্যে বন্দী করে নিয়েছিল – ফ্রয়েড বুঝেছিলেন, অষ্ট্রিয়ায় আর নিরাপত্তা নেই। ফ্রয়েড সপরিবারে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর বহু বছর পরে আজও মানুষের মনরোগ চিকিৎসায় ফ্রয়েডের পদ্ধতিকেই প্রাথমিক ভাবে ব্যবহার করা হয়।
আর, আজকের আধুনিক ভিয়েনার জীবন যাপনে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কি ভূমিকা থাকতে পারে – তা দেখতে ভিয়েনার সিগমুন্ড ফ্রয়েড পার্কে একবার আসতে হয়। একদিকে ভিয়েনার প্রধান ইউনিভার্সিটি ও একদিকে Votiv church এর মাঝে এই সবুজ জায়গা, সত্যি যেন স্থানীয় ও টুরিস্টদের ক্লান্ত মনের বিশ্রামের ঠিকানা।
ফ্রয়েড সত্যি আমাদের জীবনের অনেক অদেখা বদ্ধ পরিসরে আলোকপাত করেছিলেন… তাঁর কাজ তাই বহু সমালোচনা সত্ত্বেও সমাদৃত…
হ্যাঁ, সত্যি তাই। ঠিক বলেছেন।