ইউরোপের নদী – রোণ (The Rhône River)

যেখানে অসীম গভীর জলরাশি দুরন্ত ঘূর্ণি স্রোতে পাক খেতে খেতে লেক জেনেভাকে বিদায় জানিয়ে, সুইজারল্যান্ড ছাড়িয়ে রওনা দিয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের দিকে – ঠিক সেখানেই আমাদের রোণ নদীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, নদী এখানে বিস্তারিত, গভীর, দামাল, উত্তাল।

আর সেই রোণ নদীর গভীর নীল জলে যতই চঞ্চলতা, যতই ঘূর্ণি স্রোত ছিল না কেন, সেই সুইস বিকেলটি কিন্তু ছিল অদ্ভুত শান্ত, গভীর নীল। রোণ নদীর বুক ছুঁয়ে আসা এক ঠাণ্ডা এলোমেলো হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।

ইউরোপের অন্যতম দীর্ঘ এই নদী সুইস আল্পসের Rhône গ্লেসিয়ার থেকে উৎপন্ন হয়ে লেক জেনেভায় এসে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েই ফ্রান্সের দিকে বয়ে চলেছে। ফ্রান্সের Arles শহরের কাছে এসে দুই ভাগে ভাগ হয়ে মেডিটেরিয়ানের উদ্দেশ্যে বয়ে চলেছে।  আর এই দুই ভাগে বিভক্ত হতে গিয়ে বদ্বীপও তৈরি করেছে এই নদী। আবার ফ্রান্সের লিও শহরের কাছে এসে রোণ নদীর সঙ্গে Saône   নদী এসে যোগ দিয়েছে।

ইউরোপের গ্রীক ও রোমান যুগ থেকে শুরু করে, রেল লাইনের উন্নতির আগে পর্যন্ত এই নদী পথ ফ্রান্সের বহু শহরের মধ্যে ও মেডিটেরিয়ানের বন্দর গুলোর মধ্যে অন্যতম যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে এই নদীপথে বহু লাক্সারি রিভার ক্রুজের চলাফেরা লেগেই থাকে।

নদীর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বহুদিনের – ভিনসেন্ট ভ্যান গো এর তুলিতেও ফ্রান্সের এই বিখ্যাত নদীর রূপ ধরা দিয়েছে।

যাইহোক, ত্রিশের দশকে ফ্রান্স, রোণ নদীর জলকে বাগে এনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প নিয়েছিল, কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় সেই কাজ থমকে যায়। ইতালিয়ান ফ্যাসিস্ট সেনারা দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের, রোণ নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত জায়গা দখল করে নিয়েছিল।

নদীকে কেন্দ্র করে মানুষের সভ্যতার ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস বহু প্রাচীন, বহু শহর গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে, আর আজও মানুষের তৈরি সভ্যতা, ও শহরের উন্নতির আবর্জনার যাবতীয় অত্যাচার নদীকেই সহ্য করতে হয়, ফ্রান্সের রোণ নদীও শহরের উন্নতির যাবতীয় অত্যাচার সহ্য করেছিল, কিন্তু, নদীরও তো সহ্যের এক সীমা থাকে। পরিনতি হয় বন্যা, নদীর মাছেরা নদী ছেড়ে চলে যায় – রোণ নদীর কোন কোন মাছের প্রজাতি নাকি রোণ নদী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

তারপর, মানুষ হয়তো কোন এক সময় তার ভুল বুঝতে পারে – তাই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে, ফ্রান্সে যখন সব কিছু আবার নতুন করে গঠন করার তালিকা তৈরি হয় – এই রোণ নদী সেই তালিকায় বিশেষ গুরুত্ব পায়।

ফ্রান্স এই নদীকে দূষণ মুক্ত, আবর্জনা মুক্ত করে প্রচুর বাঁধ ও ক্যানাল তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করারও প্রকল্প তৈরি করে। সে ছিল এক বিশাল প্রকল্প, এমনকি আজও ফ্রান্স ধাপে ধাপে রোণ নদীকে সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ করে চলেছে। আর তাই যে মাছেরা এক সময় জল দূষণের জন্যে রোণ নদী ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারাও নাকি ফিরে এসেছে, রোণ নদীর জল, পানীয় যোগ্য হয়েছে। রোণ নদীর তীরে বসবাসরত এক ফরাসী মহিলার ভাষায় – প্রকৃতির সম্পদ বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব যে মানুষেরই, তা একটু দেরীতে হলেও মানুষ যে বুঝতে পেরেছে – সেটাই আসল।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Switzerland, Travel, Western-Europe and tagged , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s