কে ছিলেন শ্রীনিবাস রামানুজন যার অসামান্য গাণিতিক প্রতিভা বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত গণিতজ্ঞদের আশ্চর্য করে দিয়েছিল, বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল, ভাবিয়েছিল। খুবই অল্প বয়স থেকেই অংকের প্রতি রামানুজনের ছিল গভীর আগ্রহ।
শোণা যায়, রামানুজন মাত্র এগারো বছর বয়সেই কলেজ ছাত্রদের অংকের সমাধান করে দিতেন। কিন্তু, ব্রিটিশ ভারতবর্ষে, মাদ্রাসের মতো জায়গায় শ্রীনিবাস রামানুজনের মতো অংক প্রতিভার কথা স্থানীয় লোকের গল্প গাঁথায় জায়গা করে নিলেও, ভারতবর্ষের প্রতিভাবান গণিতজ্ঞদের মধ্যে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিতে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছিল দীর্ঘ পথ। আর সেই পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ধৈর্য, অধ্যবসায় ও মনোযোগের পরীক্ষা, আর সঙ্গে প্রতিভা তো ছিলই।
মাদ্রাসে থাকাকালীন শ্রীনিবাস রামানুজনের হাতে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ G. S. Carr এর A Synopsis of Elementary Results in Pure and Applied Mathematics বইটি আসে – বইটি যদিও অংকের একটি রেফারেন্স বই ছিল, কিন্তু রামানুজন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়েছিলেন। সেই বইয়ে অংকের প্রায় পাঁচ হাজার অদ্ভুত ও রহস্যময়, সমাধানহীন থিওরেম ও সমস্যাই রামানুজনের গাণিতিক প্রতিভাকে জাগ্রত করেছিল। একটা খাতায় তিনি সেই বইয়ের সমাধানহীন সমস্যা গুলোর সমাধান গুলোকে যত্ন করে লিখে রাখতেন – তাঁর ভাষায় অংকরা , অংকের সমাধানরা নাকি তাঁর কাছে ধরা দিত, তাঁর কাছে আসতো।
রামানুজন অংকের প্রায় তিন হাজার সমস্যার সমাধান করেছিলেন, শুধু তাই নয় জটিল সমীকরণের সমাধান থেকে শুরু করে যৌগিক সংখ্যার অনন্ত সিরিজের ধর্ম – সবই তাঁর কাছে ধরা দিয়েছিল।
আর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, মাদ্রাসের শিপিং অফিসে কাজ করতে করতে রামানুজন যখন ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ H. F. Baker ও E. W. Hobson কে তাঁর অনন্ত সিরিজের সমীকরণ ও সমাধান সহ চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন – তাঁরা কোন উত্তর না দিয়ে শুধু তাঁর সমাধান গুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত প্রোফেসররাও প্রথমে রামানুজনের সমীকরণ ও সমাধান গুলো বুঝে উঠতে পারে নি।
কিন্তু, আবার সেখানেই ছিলেন ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ G. H. Hardy । যিনি নিজেও একজন অসামান্য গাণিতিক প্রতিভা ছিলেন। রামানুজনের লেখা, নয় পাতার চিঠি, যেখানে ‘pi’ নিয়ে infinite series , ‘pi’ও ‘e’ সহ infinite continued fraction নিয়ে রামানুজনের থিয়োরি ছিল – তা দেখে তিনি সম্মোহিত হয়ে যান। রামানুজনের ইকুয়েশন গুলো দেখে তিনি বলেছিলেন – “must be true, because, if they were not true, no one would have the imagination to invent them” । তিনি তাঁর সহকর্মী J. E. Littlewood কে রামানুজনের পেপার গুলো দেখতে বলেন – দু’জনে মিলে দেখে আরও নিশ্চিত হয়েছিলেন – তাঁর ভাষায় – certainly the most remarkable I have received ।
রামানুজন প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন – “a mathematician of the highest quality, a man of altogether exceptional originality and power”। রামানুজনকে প্রোফেসর Hardy কেম্ব্রিজে রিসার্চ করার সুযোগ করে দেন। সেই ছিল প্রোফেসর Hardy ও রামানুজনের যুগলবন্দীর শুরুর গল্প – কিন্তু, পৃথিবীতে রামানুজনের হাতে সময় ছিল খুবই কম – মাত্র বত্রিশ বছর। কিন্তু, ঐ টুকু সময়ের মধ্যেই রামানুজন পিওর ম্যাথম্যাটিকসে তাঁর ছাপ ছেড়ে গিয়েছিলেন – তাঁর তৈরি অংকের অদ্ভুত রহস্যময় সিরিজ, যেমন Ramanujan prime ও Ramanujan theta function আজও মানুষকে ধাঁধায় ফেলে।
শ্রীনিবাস রামানুজনের মৃত্যুর পর প্রোফেসর Hardy প্রায় সাতাশ বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু, রামানুজনের গাণিতিক প্রতিভা তাঁকে সারাজীবন সম্মোহিত করে রেখেছিল। এমনকি প্রোফেসর Hardy রামানুজনের সঙ্গে তাঁর সম্মিলিত কাজকে “the one romantic incident in my life” – বলতেও দ্বিধা বোধ করেন নি।
ওরা এসেছিল পৃথিবীতে, সাধারণ মানুষ হয়েই এসেছিল – কিন্তু, কখনো তাঁদের কাছে ধরা দিয়েছিল কথা, কখনো শিল্প, কখনো ছবি, কখনো অংক, কখনো বিজ্ঞান, কখনো বা সুর ধরা দিয়েছিল – আর মানব জীবনের এই ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে সেই অনন্ত অসীমের বসবাসকে আমরা সাধারণ দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে কিছুতেই বুঝতে না পেরে নাম দিয়ে দিয়েছিলাম – প্রতিভা। আর সেই প্রতিভাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। আর মানুষ প্রতিভাকে দেখে অবাক হয়, আশ্চর্য হয় – তাঁর কাজ দেখে ভাবে কি করে হতে পারে? ঐ কাজ করতে একটা জন্ম, নাকি কয়েক জন্ম লাগে?
ইতিহাস হয়তো মানুষকে মনে রাখে না, মানুষের কাজকেই ধরে রাখে – আবার কাজকে ধরে রাখতে গিয়ে মানুষটিকেও যেন ধরে রাখতে চায় – পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর গল্প শুনতে চায়, তাঁকে দেখতে চায়, বুঝতে চায়, আর তখনই বোধহয় শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন ও তাঁর কাজ নিয়ে তৈরি হয় – The Man Who Knew Infinity র মতো চলচিত্র।