সেদিন Astronomical Society র সেক্রেটারি, এডিংটনের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা রেকর্ড করছিলেন – যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে পূর্ণ সূর্যগ্রহনের রেজাল্ট দিয়ে সঠিক বলে প্রমান করেছিল।
আর, আইনস্টাইনের সেই অদ্ভুত তত্ত্ব সঠিক বলে প্রমানের পরে, বিজ্ঞানের জগতের মানুষ তো বটেই, এমনকি, বিজ্ঞানের দুনিয়ার বাইরের সাধারণ মানুষ, যারা আগে কোনদিনও আইনস্টাইনের নাম পর্যন্ত শোনে নি, তারাও, আইনস্টাইনকে জানার জন্যে, চেনার জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠল। তখন আইনস্টাইনকে সবাই চিনতে শুরু করল। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল – মহাবিশ্ব নিয়ে এতোদিন ধরে সাধারণ মানুষরা যা বিশ্বাস করে আসছে, তা সম্পূর্ণ ভুল।
তখন, জার্মানি, আমেরিকা ও ব্রিটেনের খবরের কাগজের হেডলাইনে জার্মান ইহুদী বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই অদ্ভুত তত্ত্বের কথা ছাপা হয়েছিল, ছাপা হয়েছিল – নিউটনের শতাব্দী প্রাচীন থিয়োরি কি ভাবে ভুল প্রমান হয়েছে, কিভাবে, মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ এক নতুন থিয়োরির জন্ম দিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন এক নতুন সত্যের খোঁজ দিয়েছেন।
যদিও, সেই সময় বিজ্ঞানের জগতের খুব কম মানুষই আইনস্টাইনের নতুন থিয়োরিকে মেনে নিয়েছিল কিংবা বুঝতে পেরেছিল – আইনস্টাইনের নাম কিন্তু সাধারণ ইউরোপিয়ানরা প্রায় সবাই জেনে গিয়েছিল। এমনকি, সেই সময়ে অনেক নবজাতকের নামও ‘আলবার্ট’ রাখা হয়েছিল।
আইনস্টাইন কিন্তু কখনো ভাবেননি – মহাবিশ্ব নিয়ে তাঁর এই অদ্ভুত থিয়োরি সাধারণ মানুষের কল্পনাকে, ভাবনার জগতকে এই ভাবে ছুঁয়ে যাবে, কল্পনাকে জাগিয়ে তুলবে। প্রেস রিপোর্টাররা ক্রমাগত তাঁর ফোটো চায়, লেখা চায়, লেকচার শুনতে চায় – মোটকথা, তাঁকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, সবাই প্রায় তাঁর কথা জানতে চায়, শুনতে চায়।
আইনস্টাইনকে সেই সময়ের এক তারকা বিজ্ঞানীও বলা যায়। কিংবা, বিজ্ঞানের জগতের প্রথম সুপার স্টার বিজ্ঞানী।
এদিকে, জার্মানিতে উঠে আসছিল নাৎসি পার্টি। নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে, নাৎসি পার্টির ইহুদী বিরোধী প্রপাগ্যান্ডার ফলে, ইহুদী হিসাবে তাঁকেও জার্মানি ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
ইউরোপ ছেড়ে যাওয়ার আগে লন্ডনের Royal Albert Hall এ তাঁর শেষ বক্তৃতা ছিল, সেদিন, তাঁর কথা শোণার জন্যে, যে লেকচার হলে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের জায়গা হয়, সেখানে দশ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিল।
সেদিন, সেই সম্মেলনে বক্তৃতায় তিনি জার্মানির, তথা সম্পূর্ণ ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন – ইউরোপ এক নতুন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে চলেছে, তিনি শ্রোতাদের বলেছিলেন – সাধারণ মানুষ যেন একটা জিনিস মনে রাখে, তাঁদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হতে চলেছে। সেই সম্মেলনে তিনি ব্যক্ত্বি স্বাধীনতার ব্যাপারে স্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন – Without such freedom there would have been no Shakespeare, no Goethe, no Newton, no Faraday, no Pasteur, and no Lister.
ইউরোপ মহাদেশে সেই ছিল তাঁর শেষ বক্তৃতা।
পরবর্তী কালে তাঁর বক্তৃতা তাঁর বইয়েও ছাপানো হয়েছিল। শুধু কি মহাবিশ্ব নিয়েই মহান সেই মানুষটি সঠিক ছিলেন? তা নয়, ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিয়েও যে তিনি সম্পূর্ণ সঠিক ছিলেন, তা ইউরোপ বহু রক্ত ঝরিয়ে, বহু প্রানের বিনিময়ে বুঝতে পেরেছিল।
যাইহোক, এদিকে, সাধারণ মানুষ মেনে নিলেও বিজ্ঞানীদের মধ্যে কিন্তু তখনো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর সন্দেহ, খটকা, বিরোধ লেগেই ছিল। সাধারণ মানুষ যত সহজে আইনস্টাইন ও তাঁর থিয়োরিকে গ্রহণ করে নিয়েছিল, বিজ্ঞানীরা কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। বিশেষ করে ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল, কে এই বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী? তারা কিছুতেই নিউটনের থিয়োরি ছাড়া নতুন কিছু ভাবতে পারছিল না।
কেউ কেউ তো বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, ব্রিটিশ এডিংটনের বিশ্ব ভাতৃত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল – এডিংটন বিশ্ব ভাতৃত্ববোধ প্রচার করার জন্যেই আইনস্টাইনের থিয়োরিকে সঠিক বলেছেন, বিশ্ব ভাতৃত্ববোধ প্রচারের জন্যেই এডিংটন জার্মান আইনস্টাইনের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করছিল – ইত্যাদি নানা কথার ভিড়ে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব আবার বিজ্ঞানীদের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। এমনকি, এডিংটনের সমালোচনা করে অনেক বিজ্ঞানী বলেছিল – এডিংটন পূর্ণ সূর্যগ্রহনের রেজাল্ট নিয়ে ভুল এনালাইসিস করেছেন।
আইনস্টাইন তো তাঁর থিয়োরিকে ১৯০৭ থেকে প্রমানের চেষ্টা করে চলেছেন, এদিকে আমেরিকার Campbell ও ব্রিটেনের Eddington এদের নিয়ে ব্যাপারটা শুধু যে বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয় – এক আন্তর্জাতিক ও ব্যক্তিগত নামও জড়িয়ে গেল। এক্ষেত্রে, অনেকটা ব্যক্তিগতও বলা যায়, তাই Campbell আবার পরবর্তী পূর্ণ সূর্যগ্রহনের দিন দেখলেন – অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যাবে। (September 21, 1922)
চলবে