ছোটোখাটো চেহারার এক জার্মান ইহুদী এক ঝটকায় নিউটনকে ভুল প্রমান করে দিল! কিন্তু, আইনস্টাইনের ব্যাখার প্রমান কোথায়? – তখন কেউই আইনস্টাইনের ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কেউই সেদিন আইনস্টাইনকে সম্পূর্ণ বুঝতে পারেন নি।
কিন্তু, আইনস্টাইন জানতেন মহাবিশ্বের শক্তির, অসীম রহস্যের সমীকরণটিকে তিনি ঠিকই ভেবেছেন। আবার এও জানতেন, প্রমান করতে না পারলে কেউই তাঁর কথা মেনে নেবে না। আর সেই প্রমান শুধুমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহনের সময়ই হতে পারে। আবার আইনস্টাইনকে সূর্যগ্রহনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
আইনস্টাইন সঠিক গাণিতিক সমীকরণ সহ, তাঁর সম্পূর্ণ জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির পেপারটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত করলেন। কিন্তু, তখনো অনেক কাজ বাকি ছিল। পূর্ণ সূর্যগ্রহনের ফোটো চাই।
কিন্তু, এদিকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী বার্লিনের অবস্থা তখন খুবই শোচনীয়, এমনকি বার্লিনের সাধারণ মানুষের খাদ্যদ্রব্যেরও অভাব হয়ে পড়েছিল। আবার আইনস্টাইনও মারাত্মক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাঁকে কাজ থেকে বিরতি নিয়ে, বিশ্রাম নিতে হয়েছিল।
এদিকে, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ Arthur Stanley Eddington তিনি ইংল্যান্ডের সেই কয়েকজন মানুষের মধ্যে ছিলেন যারা জার্মানদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের যুদ্ধকে বিরোধ করেছিলেন – যুদ্ধ বিরোধী Arthur Stanley Eddington এর সঙ্গীরা একে একে গ্রেপ্তার হচ্ছিল – কিন্তু, তিনি ছিলেন কেম্ব্রিজের এস্ট্রোনমি শাখার প্রধান – কিন্তু, তিনি আইনস্টাইনের নতুন জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির ব্যাপারে ১৯১৬ র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় কিছুই জানতেন না – কারণ বিশ্ব যুদ্ধ ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার স্বাধীন আদানপ্রদানকে, বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে সুস্থ চিন্তার যোগাযোগকে সম্পূর্ণ ছিন্ন করেছিল – তাই, জার্মান জ্ঞান বিজ্ঞান ও টেকনোলোজির নতুন আবিষ্কারের কথা ইংল্যান্ডের কাছে অজানাই ছিল।
এমনি এক সময়ে, একদিন, Eddington, এক প্যাকেট পেলেন – প্যাকেটটি পাঠিয়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ, নেদারল্যান্ডের জ্যোতির্বিদ Willem de Sitter । প্যাকেটে আইনস্টাইনের নতুন জেনারেল থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির সেই পেপার, যেখানে আইনস্টাইন গ্রাভিটি ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার ইংরেজি অনুবাদ ছিল। Eddington পেপারটি একবার পড়েই বুঝে গেলেন – এই পেপারের এক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য আছে। তিনি তাড়াতাড়ি Willem de Sitter কে লিখলেন – ইংল্যান্ডে কেউই তো এই বিষয়ে কিছুই জানে না, আইনস্টাইন সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে চাই, জানাও।
উত্তরে Sitter লিখলেন – আইনস্টাইনও যুদ্ধ বিরোধী, তিনিও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মেনিফেস্টো লিখেছিলেন।
Eddington ও ছিলেন যুদ্ধ বিরোধী – তাই, তিনি আইনস্টাইনের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন, ভাবলেন – তার এই জরুরি পেপার নিয়ে যুগ্ম ভাবে কিছু করতেই হবে।
কিন্তু, তিনিও আইনস্টাইনের মতো তার রাজনৈতিক দর্শনের জন্যে একাকী ছিলেন – Eddington দেখলেন এই সুযোগ, যেখানে জার্মান বিজ্ঞানীর কাজকে সমর্থন করে রাজনৈতিক নেতাদের বোঝানো যাবে – বিজ্ঞানীরা দেশ জাতির সীমানার অনেক অনেক উর্ধে, এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে, যে উদ্দেশ্য মানবজাতির মঙ্গল, সুবিধা, মানব জাতির কল্যান, যে উদ্দেশ্য মহাবিশ্বের রহস্যকে জানার আনন্দ, সেখানে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই, নেই কোন সৈন্যদলের বন্দুকের নল, নেই কোন রাজনৈতিক নেতার রক্ত গরম করানো, রক্ত ঝরানো মেকি দেশাত্ববোধ।
তিনি বললেন – নিউটনের পরে, বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যদি মেনে নিতে হয়, তবে সেটা – আইনস্টাইনের এই রিলেটিভিটি থিয়োরি, এবং তা একজন জার্মানের আবিষ্কার। যে থিয়োরি নিউটনের থিয়োরির চেয়েও উজ্জ্বল, যুক্তিপূর্ণ।
সর্বোপরি, আইনস্টাইন যুদ্ধ বিরোধী, শান্তি কামী – তাই Eddington আইনস্টাইনের পাশে থাকতে চাইলেন – ভাবলেন তার সহকর্মী যারা জার্মানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন করে চলেছে, তাঁদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন – এই সময়েও এক ইংরেজ, এক জার্মানের পাশে দাঁড়াতে পারে। এবং, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণই জার্মানের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে এক সুবর্ণ সুযোগ।
কিন্তু, পরের পূর্ণসূর্যগ্রহণ ১৯১৮ র আট জুনে দেখা যাবে – কিন্তু, ব্রিটেন থেকে দেখা যাবে না – দেখা যাবে ওয়াশিংটন থেকে। যুদ্ধ চলাকালীন, ইউরোপিয়ানরা সেখানে যেতে পারে না। তাই যুদ্ধই অবশেষে Eddington কে আটকে দিল।
তার মানে, আবার সেই Campbell কাছেই ফিরে যেতে হবে – কিন্তু, Campbell এর সমস্ত ভালো যন্ত্রপাতি তো রাশিয়ার ক্রাইমিয়াতে, যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়ানরা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল।
চলবে