কয়েক জন মিলে ভাবল এবার তাহলে গ্রীস ছেড়ে ইউরোপের অন্য কোন দেশে যেতে হবে। সঙ্গে নেই কোন পরিচয় পত্র, নেই কোন টাকা পয়সা। পরিচয় পত্র যা ছিল, সে তো গ্রীসে ঢোকার আগেই দালালের উপদেশে ছিঁড়ে ফেলেছিল – তখন পরিচয়হীনতাই নাকি মূল অস্ত্র ছিল। তাছাড়া, সোজা পথে অন্য দেশে ঢুকতে হলে তো দু’টোই চাই।
ওরা দল বেঁধে পরামর্শ করল, যে ভাবে এই দেশে ওরা লুকিয়ে এসেছে, ঠিক তেমন করেই লুকিয়ে ইউরোপের অন্য দেশে ঢুকতে হবে, যেখানে চাকরি আছে, খাদ্য আছে, যে দেশের ভাষা বোঝা যায় – ইংল্যান্ড!
কিন্তু, লুকিয়ে অন্য দেশে ঢোকা তো সহজ নয়। প্রতি পদে পদে লুকিয়ে আছে বিপদ, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়, একবার ধরা পড়ে গেলে ফিরে যেতে হবে নিজের দেশে কিংবা ডিটেনশন ক্যাম্পের নরকের মধ্যে থাকতে হবে – কিন্তু, ওদের তো জীবনে আর হারানোর কিছুই নেই, এখানে আসার জন্যে সব হারিয়েই এসেছে, তাই কোন রকম ঝুঁকি নিতেই ওরা এখন আর ভয় পায় না।
বহুদিন সুযোগের অপেক্ষায় থেকে, বেশ কিছুদিন ধরে এথেন্সের রাস্তার দোকানে, হোটেলের মাল বয়ে দিয়ে, নানান খুচরো কাজ করে একটু একটু করে বেশ কিছু ইউরো জমিয়ে ফেলেছিল লোকটা। ওদের দলের একজন এক দালালের খোঁজ নিয়ে এসেছিল – সে আবার ইউরোপেরই লোক, দালালটি ওদের দলের কয়েকজনকে ইউরোপের অন্য দেশে পৌঁছে দিতে পারে। অবশ্য, বেশ কিছু ইউরো লাগবে। যাইহোক, লোকটা ও তার দলের মানুষরা সবাই খুব মরীয়া, যেমন করেই হোক, গ্রীস ছেড়ে ইউরোপের অন্য দেশে যেতে চায় ওরা।
লোকটার সঙ্গে, এক মানুষ পাচারের দালালের কথা চলছিল। ঢাকা ট্রাকে করে ট্রাক ড্রাইভাররা অন্য দেশে পাচার করে দেবে, কথা দিয়েছিল। কিন্তু, ট্রাক চালকরা প্রায় দু’শো ইউরো চেয়ে বসেছিল।
কোনরকমে, সেই দু’শো ইউরো জমে যাওয়ার পরেই সে চেপে বসেছিল এক ঢাকা দেওয়া সবজির ট্রাকে, ইঁদুরের মতো সবজির বস্তার পিছনে লুকিয়ে বসেছিল।
ট্রাকের দুলুনিতে চলতে চলতে কি ভাবছিল – সে কথা তার বিন্দুমাত্র মনে নেই, সঙ্গে আরও কয়েকটা অচেনা মুখও ছিল, প্রতিটি শুকনো মুখেই অনিশ্চিত জীবনের এক দুঃশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পেয়েছিল সে, কিন্তু, তবুও যেন সেই মুখ গুলোর পেছনে এক উজ্জ্বল জীবনের আশা তো লুকিয়ে ছিলই। কিন্তু, ওরা কেউই একে ওপরের সঙ্গে কোন কথা বলে নি। কোথাও ট্রাক থেমে গেলেই, আতঙ্কে সবার মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছিল – সীমান্ত রক্ষীর হাতে ধরা পড়ে গেলে কি হবে সেই কথা ভেবে।
এই উদ্দেশ্যহীন দীর্ঘ পথে কেউ কারোর বন্ধু নয়, সবাই সহযাত্রী।
দীর্ঘ যাত্রার শেষে, এক অন্তহীন সময়ের পথ চলায়, যখন ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রাক থামল, ট্রাক ড্রাইভারের গলা শোণা গেল। বুঝল, এবার সবাইকে এখানেই নেমে যেতে হবে। যে শহরে ট্রাক চালক নামিয়ে দিয়ে বলেছিল – এই শহরের নাম নেপলস, ইতালির শহর, তোমরা এখন ইতালিতে চলে এসেছ।
সন্ধ্যার অন্ধকারে সে নেপলসের কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। এথেন্সের দালাল নেপলসের আরেক দালালের সঙ্গে দেখা করার কথা বলেছিল, কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকারে, নতুন দেশে, নতুন শহরে কোথায় তাকে সে খুঁজতে যাবে।
অগত্যা, ষ্টেশনের আশেপাশেই কোন রকমে রাত কাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবল। অন্তত, মাথার উপরে ষ্টেশনের ছাদ তো আছে, ষ্টেশনের বাথরুমে খাওয়ার জল আছে।
নতুন দেশের ষ্টেশনের জনস্রোতের দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আধশোয়া হয়ে সে ভাবল – এবার তাহলে শুরু হবে আরেক জীবন। এখানে তার জন্যে কি অপেক্ষা করে আছে কে জানে?
লোকটার জীবনে সত্যিই শুরু হল এক নতুন অধ্যায়।
তারপর, তো নেপলসের রাস্তায়, বন্দরে, ষ্টেশনে তাকে ভিক্ষাও করতে হয়েছে, কিন্তু, সারাদিনে হয়তো পাঁচ ইউরোও হয় নি। স্থানীয় ভিখারিদের সঙ্গে মারামারিও হয়েছে – ভিক্ষা করতে বসার জায়গা নিয়ে। কুলির কাজ করেছে খুবই কম ইউরোর বিনিময়ে।
রিসেসনের বাজার- ইতালিতে সবাই কম পয়সায় কাজ করতে চায়, আর লোকটিরও কাজ চাই, তাই সারাদিনে পাঁচ ইউরোর বিনিময়েও মাল বহন করেছে। বন্দরে ছোটখাটো ব্যবসা করার চেষ্টা করেছে – ছাতা, পুতুল, লেডিজ ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রির চেষ্টা করেছে। কিন্তু, লাভের প্রায় ষোল আনাই তুলে দিতে হত স্থানীয় মাফিয়াদের হাতে।
এমনকি ড্রাগসও বিক্রি করতে হয়েছে, ছোটখাটো চুরি ছিনতাইও করতে হয়েছে। ধীরে ধীরে নেপলসে থাকা তার পক্ষে বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। তাই স্থানীয় মাফিয়াদেরই এক সদস্যের পরামর্শে লোকটির এই ভিসুভিয়াস যাত্রা।
লোকটির যখনই খেয়াল হল, যে ভুল পথে চলে এসেছে নেমে পড়ল পরের ষ্টেশনে। গরমের সময়ে ইতালিতে খুব গরম পড়ে। এখন মে মাস, খুব রোদ্র আর গরম। ইতালির এই দিকটা বেশ রুক্ষ এবং সুন্দর। যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত ঢালু উঁচুনিচু জমি। দূরে পাহাড় শ্রেণী। রুক্ষ দূর দিগন্ত হালকা এক ধোঁয়াশা বা কুয়াশায় ঝাপসা। গরম হাওয়ায় লেবু ফুলের মাতাল করা এক গন্ধ।
ইতালির গ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রার ছাপ, বাড়ীর উঠোনে নানা রঙের, নানা আকারের কাপড় শুকচ্ছে, হাওয়ায় রঙিন কাপড় গুলো আপন মনে দুলতে দুলতে যেন গ্রামের ঐ বাড়ী গুলোর বাসিন্দাদের সহজ সরল নিশ্চিন্ত জীবনের এক গল্প বলছে। লোকটার মনটা যেন মুচড়ে উঠল, মনটা হু হু করে এক ছুটে চলে গেল দেশে, নিজের গ্রামে।
লোকটার মনটা কি একটু দুর্বল হয়ে গেল! চোখের কোণে কি জলের রেখা দেখা গেল? স্পষ্ট বোঝা গেল না। নাকি ‘এল ডোরাডো’র স্বপ্নে বিভোর ওর চোখ দুটো? লোকটা বিনা টিকিটের যাত্রী, তাই ওর টিকিট কাটার কোন তাড়া নেই। নিশ্চিন্তে পরের ট্রেনের জন্যে অলস অপেক্ষা করতে লাগল আর বিদেশী মানুষ জনের চলাফেরা, যাওয়া আসা, হাসি, কথা, ওদের জীবনের দৈনন্দিন ছন্দের দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করতে লাগল, আর নিজের গহন মনের স্বপ্ন গুলোকে একটু আলতো ছুঁয়ে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করল, হয়তো একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাসও ফেলল – আশেপাশের মানুষ গুলো কি বুঝতে পারল? একটু সচেতন হয়ে গেল লোকটি।