জাগ্রেব শহরের মাঝে যে পথটি বাঁক নিয়ে ঢালু উঠে গেছে উপরে – পুরনো জাগ্রেব তথা Gradec এর দিকে, সেই পথে চলতে চলতে, এক পাথুরে দরজার কাছে এসে স্থানীয় মানুষ ক্ষণিক দাঁড়ায় – মোমবাতি জ্বালিয়ে তাদের সুখ, স্বাস্থ্য, শান্তি, সৌভাগ্য ও ভালোবাসার জন্যে প্রার্থনা করে । শুধু কি স্থানীয় মানুষ!
ধূসর দিনে জ্বলন্ত মোমবাতির তিরতিরে শিখা আমাদের মতো টুরিস্টদেরও পথ আটকায়, দৃষ্টি আকর্ষণ করে – অলীক শক্তির প্রতি মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোদুল্যমান শিখার মতো এখানের জলন্ত মোমের শিখায় জড়িয়ে আছে নানান বিশ্বাস, নানান গল্প।
জাগ্রেবের স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করে – এই পাথুরে দরজার পাশে, মাতা মেরীর ছবির কাছে গিয়ে প্রার্থনা করলে মনের সমস্ত বাসনা পূর্ণ হয়। সেই বিশ্বাস এতোই দৃঢ়, যে সোভিয়েত আমলে খোলা পাবলিক জায়গায় সমবেত প্রার্থনায়, ধর্ম বিশ্বাসে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জাগ্রেবের মানুষ যাওয়া আসার পথে এই পাথুরে দরজার কাছে এসে তাদের মনের গভীর বিশ্বাসে আঁচড় পড়তে দেয় নি। তাই বলে, পথের ধারের সেই ছোট্ট জায়গায় ভক্তের অহেতুক উপছে পড়া ভিড় নেই, আছে এক নিশ্চিন্ত, নির্জন প্রশান্তি, মৃদু হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিরতিরে জ্বলন্ত মোমের শিখা।
তেরো শতাব্দীতে যখন জাগ্রেবের Gradec অঞ্চলকে ঘিরে পাথুরে সুরক্ষা দেওয়াল তৈরি হয়েছিল – এই গেটের মতো আরও কয়েকটা গেট তৈরি হয়েছিল। সেই কয়েকশো বছর পুরনো দেওয়াল ও গেটের যা কিছু সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে এই পাথুরে দরজা অন্যতম। তাই জাগ্রেবের ইতিহাসে এই পাথুরে দ্বারের অবদান অনস্বীকার্য।
এই দরজা সত্যি তিনশো বা চারশো বছর আগে কেমন দেখতে ছিল, কেন এই দরজার নাম Stone Gate হলো, ছাদ ছিল, কি ছিল না – সে নিয়েও আছে প্রচুর রহস্য, প্রচুর মতভেদ। তবে, তখন জাগ্রেবের সমস্ত বাড়ী যখন কাঠ দিয়ে তৈরি হোতো, এই দরজা যে পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিল – সে নিয়ে কোন দন্দ নেই।
সতেরো ও আঠারো শতাব্দী জুড়ে পর পর চার বার ভয়ানক অগ্নিকান্ডে এই পাথুরে গেটের প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। আসলে সেই সময় জাগ্রেবে কাঠের তৈরি বাড়ী গুলোয় বেশ ঘন ঘনই আগুন লাগতো।
আর সেই ঘন ঘন আগুন, পাশাপাশি তৈরি বাড়ী গুলোর প্রায় সমস্ত কিছুই ছাই করে দিয়েছিল, কিন্তু, আশ্চর্যজনক ভাবে বার বার রক্ষা পেয়ে যায় মা মেরী, কোলে যীশু সহ এই ছবিটি। ছবিটি ভয়ংকর সেই অগ্নিকান্ড থেকে বার বার রক্ষা পেয়ে যাওয়ায় – ছবিটি যার কাছে ছিল, সে আঠারো শতাব্দীতেই, এই পাথুরে দরজার পাশে সুন্দর গ্রিলের ভেতরে ছবিটিকে স্থাপন করে। তারপর থেকেই জাগ্রেব বাসীর আসা যাওয়ার পথে, চলার পথে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গী এই ছবিটি।
কে সেই ছবিটি এঁকেছিল, ছবিটির বয়স কতো সে নিয়েও প্রচুর রহস্য দানা বেঁধেছে – ছবিটিতে দেখা যায় – মা মেরীর বাঁ হাতে রাজদণ্ড ও ডানহাতে শিশু যীশু। তবে স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করে, ছবিটি নিশ্চয় স্থানীয় কোন নামী শিল্পীর আঁকা।
পর পর চারবার অগ্নিকাণ্ডের পরেও ছবিটির অলৌকিক ভাবে সুরক্ষিত থাকাটা জাগ্রেব বাসীকে আশ্চর্য করেছিল – তাই এই ছবিটির অলৌকিক শক্তির প্রতি জাগ্রেব বাসীর বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছিল। ছবিটির অলৌকিক ভাবে সংরক্ষণের দু’শো বছর উপলক্ষে জাগ্রেব বাসীরা ছবিটিকে রত্ন খচিত সোনার মুকুট দিয়ে সাজিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে পাথুরে দরজার মা মেরীর এই ছবিকে protector of Zagreb আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
পৃথিবীর নানা দেশে, নানা শহরে, নানা পথের বাঁকে, নানা মানুষের মনে কতোই না বিশ্বাস জন্ম নেয়, যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বাসই মানুষকে পথ চলার প্রেরণা দেয় – বিশ্বাস ধর্মে, বিশ্বাস কর্মে, বিশ্বাস বিজ্ঞানে, বিশ্বাস শিল্পে, বিশ্বাস শিক্ষায়, বিশ্বাস জীবনে, কিন্তু, যখন পৃথিবী জুড়ে মানুষের বিশ্বাসে বিশ্বাসে সংঘর্ষ বাঁধে মানুষ তখন যায় কোথায়? তার চেয়ে বরং, বিশ্বাস থাকুক নিজের মনে, পথ চলার প্রেরণা দিক বিশ্বাস, প্রশান্তি দিক, অন্ধকার পথ শান্ত মোমের শিখার মতো আলোকিত করে দিক – ঠিক যেমন জাগ্রেবের পথের বাঁকে পাথুরে দরজার মোমের শিখারা দেয়।