বৃষ্টি ভেজা ধূসর দিনে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের শ্যাওলা সবুজ ধূসর জল সেদিন ফুলে ফুলে উঠছিল, আর মুড়ানোর গ্র্যান্ড ক্যানালের ঘোলা জল মাতাল হয়ে তীরে এসে সজোরে এলোমেলো ভাবে ধাক্কা দিয়েই চলেছিল – জোলো বাতাসে সেদিন ছিল ঠাণ্ডার এক তীক্ষ্ণ তীব্রতা। বাইরে যখন এমনি এক ধূসর ভেজা ভেজা আবহাওয়া, ঠাণ্ডা, মাতাল বাতাস – তখন মুড়ানোর গ্লাস ফ্যাক্টরির ভেতরে ফার্নেসের উচ্চ তাপমাত্রা, লাল আগুন, উষ্ণতা সব মিলিয়ে রীতিমত এক আরামদায়ক উষ্ণ অনুভূতি দিয়েছিল।
মুড়ানোর শতাব্দী প্রাচীন গ্লাস ফ্যাক্টরির ভেতরে ঢুকে মনে হয় শতাব্দী প্রাচীন সময় যেন এখনো থমকে আছে, এখানে ভেনিসের চাকচিক্যময় গ্ল্যামারের কোন চিহ্ন নেই – এক প্রাচীন পরিবেশে শতাব্দী প্রাচীন টেকনিক দিয়ে আজও এখানে কাঁচের নানা জিনিস তৈরি হয়, কোন কোন শিল্পীরা তো নাকি বংশ পরম্পরায় গত কয়েকশো বছর ধরে এখানে কাঁচ তৈরি করে চলেছে।
মুড়ানোর কাঁচ শিল্পীদের তৈরি কাঁচ শুধু মাত্র কাঁচ নয় – এক অন্যরকমের শিল্প। এখানে শিল্পীরা কাঁচের মধ্যে তাদের শিল্পী স্বত্বাকে ফুটিয়ে তোলে। ভেনিসে কাঁচ তৈরির সুক্ষ প্রণালী, কাঁচে রং তোলা ইত্যাদির বিশেষ কারিগরি পদ্ধতির সূচনা তেরো শতাব্দীতেই হয়েছিল।
ভেনিসের কাঁচ শিল্পীরা সেই সময় তাদের সেই সুক্ষ পদ্ধতি, দক্ষতা সবই নিজেদের কাছে গোপন রেখেছিল, এমনকি সেই সময় ভেনিসের রাজা কাঁচ শিল্পীদের ভেনিস ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে বাঁধা দিত, তাই ভেনিসে সবচেয়ে বেশী কাঁচ শিল্পী দেখা যায় – কিন্তু, এমন এক আশ্চর্য শিল্পের কথা ইউরোপের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশী সময় লাগে নি, তারপর তো ভেনিসের কাঁচের সুনাম পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে প্রথমে ইউরোপের নানা জায়গায় কাঁচ তৈরি হতে শুরু হয়েছিল।
কিন্তু, ভেনিসের এই মুড়ানো দ্বীপে এখনো কাঁচ শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় ও দক্ষতায় এক নগণ্য কাঁচের টুকরো হয়ে ওঠে এক একটি মাস্টারপিস – তাকিয়ে দেখার মতো। ভেনিসের তৈরি কাঁচ এক সময় পৃথিবী বিখ্যাত ছিল – ভেনিসে Millefiori পদ্ধতিতে তৈরি কাঁচে শিল্পীরা যেন ফুটিয়ে তোলে এক একটি রঙিন স্বপ্ন। Millefiori এক ইতালিয়ান শব্দ, যার আক্ষরিক মানে করলে দাঁড়ায় – হাজার ফুল, আর সত্যিই তাই – Millefiori পদ্ধতিতে তৈরি ঝাড়বাতি, সত্যিকারেই হাজার ফুলই ফোঁটায় বটে – আলো ও কাঁচের যুগলবন্দীতে তৈরি হয় এক স্বপ্ন।
কিন্তু, ধাবমান সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে ভেনিসের প্রাচীন সেই কাঁচ শিল্পও নাকি বহু পিছিয়ে পড়েছে, এই দ্বীপের বহু কাঁচ শিল্পীরা নাকি তাদের বংশ পরম্পরার কাঁচ তৈরি ছেড়ে অন্য কাজ করতে শুরু করেছে – তবুও যে কয়েকজন আছে ভেনিসের কাঁচ তৈরির সেই প্রাচীন পদ্ধতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।
আর, তাইতো চোখের সামনে ভেনিসের কাঁচ শিল্পীর হাতে প্রাচীন পদ্ধতিতে কাঁচ তৈরি দেখতে দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর টুরিস্ট, ভেনিসের এই দ্বীপ মুড়ানোতে আসে – আর প্রায় প্র্যত্যেকেই মুড়ানো দ্বীপের শিল্পীদের তৈরি কাঁচের স্যুভেনির নিয়ে যেতে ভোলে না। সেই এক টুকরো কাঁচেই জড়িয়ে থাকে ভ্রমণ গাঁথা, পথের গল্প, আর এক টুকরো সময়। কোন এক হলুদ দুপুরে সেই কাঁচের টুকরো হয়তো সেই বৃষ্টি ভেজা দিনে নিয়ে যাবে, ক্ষণিকের জন্যেও সেই কাঁচ শিল্পীর কথা মনে হবে – আচ্ছা, আজও কি সে সেই জ্বলন্ত ফার্নেসের সামনে দাঁড়িয়ে এক মনে কাঁচ তৈরি করে চলেছে?