অক্টোবরের উজ্জ্বল ঝকঝকে সেই সুইডিশ দিনটি যখন বেলা শেষের প্রহর গুনছিল, আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম গথেনবার্গের সেন্টাল বাস ষ্টেশনে। প্রচুর বাস দাঁড়িয়ে – প্রত্যেকটি বাসের ভিন্ন ভিন্ন গন্ত্যব্যে আমরা ছিলাম দিশেহারা – কোন বাসে চড়ে বসব, সে নিয়ে ছিল বিশাল এক প্রশ্ন। কারণ, গথেনবার্গ থেকে বাসে চেপে গথেনবার্গের উত্তরের দ্বীপ গুলোতে যাওয়া যায় – সেই ছোট ছোট দ্বীপ গুলো সেতু দিয়ে সংযুক্ত – সাধারনত বাস ও গাড়ি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
আসলে এই সেন্টাল স্টেশন থেকে বাসে চড়ার পেছনে আরও একটি বিশেষ কারণ হল – বাসটি যাত্রী সহ ফেরীতে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দেয় – অনেকটা যেন বাসে চেপে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো ব্যাপার – বিশাল বিশাল ফেরী গুলোতে একসঙ্গে অন্তত চারটে বাস ও প্রচুর ছোট ছোট গাড়ি যাতায়াত করতে পারে – সে এক বিশাল যজ্ঞ, দেখার মতো ব্যপারই বটে।
যাইহোক, আমাদের দিশেহারা ভাব দেখে এক সুইডিশ যুবক এগিয়ে এসে, এক বাসের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল – যদি উত্তরের দ্বীপ গুলোতে যেতে চাও, তবে ঐ বাসে চেপে পড়।
দোতালা বাসের প্রথম দিকের সীটে বসতে না বসতেই শুরু হয়ে গেল যাত্রা। কিছুদূর গিয়ে Lilla Varholmen ফেরী ঘাটে ফেরীর জন্যে অপেক্ষা শুরু হল – ফেরী না বলে দৈত্য বলাই বোধহয় ভালো – কারণ সমুদ্রের বুক চিড়ে যে হলুদ যন্ত্রটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, তার আকার দেখে আশ্চর্যই হতে হয়। আমাদের কাছে যা অতি আশ্চর্যের এখানের মানুষের কাছে তা নিত্য দিনের ব্যাপার – তাই অন্যরা সবাই প্রায় ভাবলেশহীন মুখেই বসে – বাসে চেপে সমুদ্র যাত্রা ওদের কাছে দৈনন্দিনতার এক অঙ্গ।
যাইহোক, ফেরী থেকে নেমে বাস আবার নিজের পথ ধরে নিয়ে একে একে উত্তরের দ্বীপ গুলোকে বুড়ি ছুঁই করে নিতে শুরু করল , একে একে Hönö, Fotö, Öckerö , Hälsö মানে, উত্তরের দ্বীপ গুলোতে বাস আমাদের নিয়ে গেল, এদের মধ্যে ওকেরো দ্বীপটি অপেক্ষাকৃত বড় – নির্জন পথ ধরে, জন বসতির মাঝ দিয়ে, চার্চের পাশ দিয়ে যেতে যেতে, থামতে থামতে বাস চলল নিজের ছন্দে – নির্জনতার মাঝে কখনো বা কোন স্থানীয় একজন দাঁড়িয়ে বাস থামিয়ে চেপে পড়ে, আবার কিছু দূরে গিয়েই নেমে পড়ে ।
বাসে বসে বসে আমরা ঐ দ্বীপ বাসীর ছন্দোবদ্ধ দৈনন্দিনতার সাক্ষী হয়ে রইলাম। বাসের জানালা থেকেই দেখি সূর্য সমুদ্রের ওপাশে আকাশ রাঙিয়ে দিয়েছে – এক অপূর্ব সৌন্দর্যে চারিদিক মনোরম, আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। আর জাঁকিয়ে শীত নামতে শুরু করে দিয়েছে। সুইডিশ এই দ্বীপে প্রকৃতি, মানুষ, টেকনোলোজি – সব কিছুর সাক্ষী হয়ে, এক অদ্ভুত ভালোলাগার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হয় – যে অভিজ্ঞতার রেশটুকু রয়ে যায়।