শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক লিসবন শহরকে ছুঁয়ে যে নদীটি বয় – নাম তার তাজো (Tajo)। স্পেন ও পর্তুগালের অন্যতম দীর্ঘ এই নদীটি নানা জায়গা দিয়ে বয়ে যেতে যেতে, লিসবনের কাছে এসেই অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরে নিজেকে উজার করে দেয়। তবে আধুনিক এই তাজো নদীর জল অ্যাটল্যান্টিকে মিশে যাওয়ার আগে, স্পেন ও পর্তুগালে এই নদীর বুকে কয়েক ডজন ড্যাম তৈরি হয়েছে।
আর, লিসবনের কাছে এসে তাজো নদীর বুকে বিস্তৃত এক উদারতা দেখা যায়, ঢেউয়ের তালে এক উত্তাল উন্মাদনা দেখা যায় – আর জুলাইয়ের ঝকঝকে উজ্জ্বল দুপুরে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে, তাজো নদীর এ থেকে ও পার একদম ঝাপসা দেখায় – প্রথম দেখায় তাই সমুদ্রেরই এক অংশ বলে ভুল হতেই পারে।
এই সেই নদী, যার বুকে জাহাজ ভাসিয়ে পর্তুগালের নাবিকরা এককালে নতুন এক পৃথিবীর খোঁজে বেড়িয়ে পড়েছিল – ভারতবর্ষ আবিষ্কার করেছিল। তারপর, সেই নতুন পৃথিবী থেকে, নিয়ে আসা ধন দৌলত, অর্থ সবই এই নদীর পথ ধরেই লিসবনে এসেছিল – লিসবন শহরকে গড়ে তুলেছিল।
তাই, পর্তুগালের আবিষ্কারের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে এই নদীর কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। শুধু কি আবিষ্কারের স্বর্ণযুগের ইতিহাস? লিসবন শহরের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে তাজো নদীর অবদান বহুকালের – রোমান সময়ে বিস্তৃত এই তাজো নদীর জন্যেই লিসবন এক গুরুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত বন্দর ছিল।
আর প্রাচীন সেই স্বর্ণযুগের আঁচ পাওয়ার জন্যে, আজও টুরিস্টদের জন্যে তাজো নদীর বুকে জাহাজের ব্যবস্থা আছে – নদীর বুকে জাহাজে ভাসতে ভাসতে, অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে লিসবনকে দেখা আর কি। তাছাড়া, নদীর তীরের বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেও তাজো নদীর বুক ছুঁয়ে আসা মাতাল তেজী হাওয়াকে অনুভব করা যায় – জুলাইয়ের গরমেও সেই হাওয়ায় এক ঠাণ্ডা পরশ থাকে।
তাজো নদীর তীরে বসে, শতাব্দী প্রাচীন লিসবনের আধুনিক জন স্রোত, চুইয়ে চুইয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু সময় ও চোখের সামনে নদীর স্রোতের অগুনতি ঢেউ বয়ে যেতে দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত ঘোর লাগে মনে – মনে হয়, কি অদ্ভুত মানুষের বেঁচে থাকার মুহূর্ত গুলো। নদীর স্রোতের মতোই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এগিয়ে চলেছে এক অনন্তের দিকে – তারপর? জীবনের কোন এক শেষ বিকেলে যখন তাজো নদীর তীরে কাটানো মুহূর্তটির কথা মনে পড়বে, হয়তো সেদিন জীবনের পথ ধরে অনেকটাই এগিয়ে যাবো, তাজো নদীর তীরে ফেলে আসা বিকেলকে কিছুতেই আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না – কিন্তু, স্মৃতির কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা ছবি গুলোকে তো ফিরিয়ে আনতে পারবো, সে তো মলিন হবার নয়।