মুখ না মুখোশ? – দুই (Story)

Story - mukh na mukhosh - 2

হোটেলের রুমে বসে মুখ বদল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যস্ত লোকটি, কিন্তু ঐ আসন্ন বিপদ সমন্ধে কোন আঁচ পায় নি।

যখন, হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছিল গুন্ডা জাতীয় দুই জনের সন্ধানী চোখ ও জিজ্ঞাসাবাদ শুনে তাড়াতাড়ি পুরনো মুখে ফিরে গেল, কানের পাশ দিয়ে বিপদ চলে গেল, লোকটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

এবার লোকটির জীবনে শুরু হল এক নতুন অধ্যায় – আবার বন্ধুটির রূপ ধারণ করে, হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে, রাস্তাতেই নিজেকে পুরনো রূপে ফিরিয়ে, সে বাড়ী ফিরে গেল। এক দিনের সেই মুখ বদলেই তার ভাগ্য ফিরে গেছে, হাতের ব্যাগ ভর্তি টাকা সন্তর্পণে ডিভানের নীচে লুকিয়ে রাখল, সুটকেসটিকে সে আগেই মফঃস্বলের পানা পুকুরে বিসর্জন দিয়ে এসেছিল, তাই, অফিসের ঐ টাকা কেলেঙ্কারির সঙ্গে লোকটিকে জড়িয়ে ফেলা খুব মুসকিলই হবে।

তারপর থেকেই লোকটি দেখতে পেল, ওর জীবন ধারণ প্রচুর বদলে গেছে। দিনে সে বড়ই সাধাসিধা ভাবে অফিসের কাজ সাড়ে, কিন্তু, যে ক্লাব, যে বার, যে রেস্টুরেন্টে, যে পাঁচ তারা হোটেলে যাওয়া আগে ওর সাধ্যের বাইরে ছিল, যেখানে যাওয়া ওর কাছে এক লোভাতুর স্বপ্নের হাতছানি ছিল, সেখানে গিয়ে একটু ঘুরঘুর করে, যে কোন এক বড়লোকের মুখ ধারণ করে ভেতরে ঢুকে দিব্যি আনন্দ নেওয়া যায় – তার এই দ্বৈত জীবনের কথা কেউ জানতেও পারে না।

সেই আনন্দের নেশা ওকে এমনি পেয়ে বসল, যে, কোন কোন রাতে ও পাঁচ থেকে সাত বার মুখ বদল করত। ধীরে ধীরে সেই মুখ বদলের ফ্রিকোয়েন্সি আরও বেড়ে যায়, কখনো এমনও হতে শুরু করল যে, লোকটি ঘণ্টায় তিন চারবারও মুখ বদল করে ফেলে। আর সেই সঙ্গে আরও প্রচুর কালো টাকা লেনদেনের চক্রে জড়িয়ে পড়ে। একে একে নানা বিপদ ঘনিয়ে আসে – এক মুখের বিপদ থেকে বাঁচতে আরেক মুখের আশ্রয় নেয়, এই ভাবে নানা মুখ বদলে বদলে নানা মুখের আড়ালে তার এই খেলা চলতে থাকে, কেউই ধরতে পারে না।

এক রাতে এক বার কাম রেস্টুরেন্টে মুখ বদল করে, সবে ড্রিংক নিয়ে আমেজ করে বসেছে, একদল লোক দূর থেকে দেখে ওকে যেন চিনতে পারে, ওরা এগিয়ে এসে ওর কাছে পাওনা টাকা চাইতে শুরু করল।

লোকটি বারবার বলল – আমি সে নই, আমি সে নই, তোমরা ভুল করছ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বাকবিতণ্ডা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। লোকটা কোন রকমে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গলি ধরে ছুটতে শুরু করে, আর একটা মুখ মনে করার চেষ্টা করে, কিন্তু, দৌড়তে দৌড়তে উত্তেজনায় কোন মুখই মনে করতে পারে না, কানাগলির শেষ পর্যন্ত দৌড়ে যেতে যেতে লোকটি মরীয়া হয়ে এক মুখ মনে করার চেষ্টা করে – কিন্তু না, কোন মুখই মনে আসে না, এমনকি নিজের সেই পুরনো মুখটিও মনে পড়ে না, সবই ঝাপসা।

কানাগলির শেষ পর্যন্ত গিয়ে গুণ্ডাদের হাতে নিজের দুর্দশা কল্পনা করতে করতেই চোখে পড়ে কানাগলির শেষ দেওয়ালে এক নামকরা লোকের ছবি – বহুবার ওকে সে টিভিতে দেখেছে। সেই ছবি দেখে একটু মন দিয়ে ভাবতেই তার মুখ বদলে গেল – তার মুখ সেই দেওয়ালের নামকরা লোকের মুখের মতো হয়ে গেল। পেছনে তাড়া করে আসা গুণ্ডারা, চোখের সামনে টিভির তারকাকে দেখে থমকে গেল – সসম্মানে পথ ছেড়ে দাঁড়াল, একজন তো অটোগ্রাফ চেয়ে বসল। বিপদকে এমন সুকৌশলে এড়াতে পেরে লোকটির নিজের কাঁধ নিজেই চাপড়াতে ইচ্ছে করল। আনন্দে সিটি দিতে দিতে, হ্যালোজেন আলোয় আলোকিত শহরের শুনশান গলি পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল।

সামনের গলির মোড়ে বাঁক নিতেই মাথায় এক সজোরে আঘাত পড়লো – গলির ভিখারি বুড়োটা একটা সাবল দিয়ে সেই মারাত্মক আঘাত হানল, লোকটা জ্ঞান হারাতে হারাতে শুনতে পেল বুড়ো বলছে – কতদিন তোর জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম, আজ তোকে বাগে পেয়েছি, তোর জন্যে তোর মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেল, তোর বডি গার্ডদের বলে রেখেছিলি, গরীব বাবা মাকে যেন ঢুকতে না দেয়, শয়তানের বাচ্চা, কষ্ট করে তোকে যেমন মানুষ করেছিলাম, এবার দেখ আমি তোর বাবা হয়েও তোকে মেরে ফেলতে পারি।

লোকটা ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিতে চেষ্টা করল – আমি সে নই। কিন্তু, উত্তর দিতে পারল না। বুড়ো চলে গেল। পরের দিন সকালে তার পুরনো মুখ সহ লোকটির মৃতদেহ আবিষ্কার হল।

আসলে, মারা যাওয়ার ঠিক আগে লোকটি নিজের আসল মুখ মনে করতে পেরেছিল, মনে পড়েছিল তার মিষ্টি মেয়ের কথা, স্ত্রীর কথা, তার পুরনো এক সরল সহজ জীবনের কথা, মারা যাওয়ার আগে তার সেই পুরনো সহজ জীবনকে বড়ই ভালো লেগেছিল। বহুদিন ধরে অন্যের মুখ নিয়ে, অন্যের রূপ ধরে বাঁচতে বাঁচতে সে যে তার নিজের মুখ, নিজের জীবনই হারিয়ে ফেলেছিল। সে মরে গিয়ে প্রমাণ করল, সে আসলে কে ছিল।

শেষ

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Fiction and tagged , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s