কেউ কি কখনো কোন ভাঙ্গা জিনিস পছন্দ করে? কোন ভাঙ্গা জিনিসের দাম কি আসল জিনিসটির চেয়েও বেশী হয়ে যায়? সুন্দর হয়ে যায়? আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, ভাঙ্গা জিনিস আসল জিনিসটির চেয়েও সুন্দর হয়ে যায়, হয়ে যায় দামী, অমূল্য এক শিল্প। কিন্তু কি ভাবে?
আলজিরিয়া বেড়াতে গিয়ে এক ফরাসী বন্ধু আমাকে দুটি চীনামাটির পাত্র এনে দিয়েছিল, আলজিরিয়ার স্থানীয় শিল্পীর হাতে তৈরি চীনামাটির পাত্র – খুব সুন্দর দেখতে। কি ভাবে একদিন হাত থেকে পড়ে, একটি পাত্র ভেঙ্গে গিয়েছিল, কিন্তু, কি ভেবে, ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে এক জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, অবসর পেলে আঠা দিয়ে জোড়া লাগাবো। শুনেছিলাম, এন্টিক দোকানে এমনি ভাঙ্গা জিনিস, চীনামাটির ফুলদানী ইত্যাদি নিখুঁত ভাবে জোড়া দিয়ে দেয়।
যাইহোক, পাত্রটি জোড়া দেওয়ার জন্যে একটু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে জানলাম – জাপানের Kintsukuroi পদ্ধতির কথা। ভাঙ্গা পটারি জোড়া দেওয়ার এক বিশেষ পদ্ধতি – যেখানে জোড়া দেওয়ার আঠার সঙ্গে সোনা, রূপো বা প্লাটিনামের গুড়ো ব্যবহার করা হয়। আর এই Kintsukuroi পদ্ধতিতে মেরামত করা পটারির দাম ও সৌন্দর্য আসল পটারির চেয়ে অনেক অনেক বেশী হয়ে যায়, মেরামত করা পাত্রটি এক শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
জানলাম, জাপানের এই Kintsukuroi পদ্ধতির পেছনে জড়িয়ে আছে এক আশ্চর্য দর্শন ‘Wabi-sabi’ – যেখানে জীবনের অসম্পূর্ণতা, অসিদ্ধতা, অস্থায়িত্বের মধ্যে সৌন্দর্য খোঁজা হয়। নশ্বর জীবনের একটু ইম্পারফেকশনই যে জীবনকে সুন্দর করতে পারে, তা এই দর্শনে মেনে নেওয়া হয়। আর Kintsukuroi পদ্ধতিতে সোনার গুড়ো দিয়ে জোড়া দেওয়া ভাঙ্গা পাত্র, যেন বুঝিয়ে দিতে চায় জীবনের ত্রুটি, অসামঞ্জ্যস্য, অসম্পূর্ণতাকে মেনে নিয়ে, এগিয়ে গিয়ে এক সম্পূর্ণ জীবন গড়ে তোলার নামই জীবন, জীবন শিল্প।
জীবন তো কখনোই সর্বাঙ্গীণ ভাবে সম্পূর্ণ সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না – জীবন তো জীবনই। জীবনের চলার পথে তো মানুষ কতো ভাবেই না ভাঙ্গে – কিন্তু, ভাঙ্গা সেই টুকরো অংশ গুলোকে যদি সোনা দিয়ে জোড়া দিয়ে আরও সুন্দর করে নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে, বাড়তে পারে, তাহলে ক্ষতি কি?