আস্পারাগাসের কথা (Asparagus)

বসন্তের শুরুতেই তুলুস সহ ইউরোপের নানা দিকের স্থানীয় বাজার থেকে শুরু করে সুপারমার্কেট সবই নরম, কমনীয়, সবুজ, কচি কচি আস্পারাগাসে ছেয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত দামী এই সবজিটিকে ফরাসীরা যে কতো রকম ভাবে খেতে পছন্দ করে! কখনো নুন জলে সেদ্ধ, কখনো গ্রিল করে উপরে চীজ ছড়িয়ে দিয়ে আবার কখনো রসুন ফোড়ন দিয়ে হালকা স্যত্যে করে নিয়ে, আবার কখনো আস্পারাগাস স্যুপ, আস্পারাগাস স্যালাড। মোটকথা সামারে ফরাসীরা এই সবজিটিকে নিজেদের পাতে নানা রূপে দেখতে চায়। তুলুসে সাধারণত দুই রকমের আস্পারাগাস পাওয়া যায় – সাদা ও সবুজ।

ফরাসীদের প্রিয় এই আস্পারাগাসকে প্রথমে ঠিক যেন বাগে আনতে পারি নি, এর স্বাদ গন্ধের সঙ্গে নিজেদের রুচিকে ঠিক মেলাতে পারি নি – কিন্তু ধীরে ধীরে আস্পারাগাস ও তার স্বাদকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে হয়েছে। আস্পারাগাসের নিজস্ব স্বাদের সঙ্গে খুব বেশী ভারতীয় রান্নার মশলা মিলিয়ে দিলেই গণ্ডগোলটি বাধে – ওকে ওর মতোই থাকতে দেওয়া উচিত, যেমন আদা রসুন কুচি ফোড়ন দিয়ে, নুন জলে আধ সেদ্ধ আস্পারাগাস খেতে কিন্তু মন্দ লাগে না, আস্পারাগাস নাকি কখনোই পুরোপুরি সেদ্ধ করতে নেই – একটু কাঁচা কাঁচা থাকলেই নাকি এর স্বাদ খোলে। চাইনিজ রান্নাতেও আস্পারাগাস কিন্তু চমৎকার যায়।

যাইহোক, কিছুদিন আগে ইউরোপের এক খবরে জানা যায়, ইউরোপের বাজারের এই ধরণের দামী সবজি বা ফলের পেছনে কিন্তু এখনো লুকিয়ে আছে বহু প্রাচীন দাসপ্রথা – যা কিনা ইউরোপে রীতিমত বেআইনি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেতরে থেকেই বেআইনি ভাবে এক আস্পারাগাস কোম্পানি রীতিমত বেআইনি দাসপ্রথা চালিয়ে গেছে, কেউই তাদের নাগাল পায় নি – আসলে আস্পারাগাস বা স্ট্রবেরির মতো নরম ফসল তৈরি জন্যে প্রচুর শ্রমিক দরকার – আর সেই শ্রমিকদের দিয়ে বিনা বেতনে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে ইউরোপে আজও এই ধরণের ফসল ফলানো হয়।

আস্পারাগাস যখন হয় – বলা হয় সবুজ বা সাদা সোনা, এবং ফসলটি খুব তাড়াতাড়ি মাঠ থেকে তুলে ফেলতে হয়, না হলে পোক্ত হয়ে গিয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তখন নাকি কোন দামই পাওয়া যায় না।

সেই রিপোর্টে জানা যায়, উত্তর-পূর্ব ইউরোপে আস্পারাগাস মরশুমে পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলো থেকে প্রচুর শ্রমিককে আস্পারাগাস ফার্মে কাজ দেওয়া হয়, বলা হয় ‘আস্পারাগাস পিকার’ – আর ওদের কাগজ পত্র, পরিচয় পত্র প্রথমেই কোম্পানি জমা করে নেয়, আর শ্রমিকদের পরিচয় প্রায় মুছেই দেওয়া হয় – আর আস্পারাগাস ফার্মে সেই অমানুষিক পরিশ্রমের পরে বেতন চাইলেই শ্রমিকদেরকে কতৃপক্ষের পোষা গুন্ডাদের বন্দুক, ছুরি চাকু, তরোয়ালের সম্মুখীন হতে হয় – প্রতিবাদে প্রানও দিতে হতে পারে, তাই মুখ বুজে শুধু কাজ করে যায় ওরা, পালানোরও নাকি কোন উপায় থাকে না। আস্পারাগাসের ফার্মের শ্রমিকদের উপরে কড়া নজর রাখা হয় – পালাতে চেষ্টা করলেও ধরে নেওয়া হয়। আস্পারাগাস তোলার মরশুম শেষ হলে, আস্পারাগাসের জন্যে জমি তৈরির মরশুম শুরু হয়।

এখানে প্রতিটি আস্পারাগাসের ডাটায় জড়িয়ে আছে প্রচুর মানুষের শ্রম, স্বেদ, অশ্রু। শুধু কি আস্পারাগাস! আমাদের প্লেটে যে খাদ্য আসে তার পেছনে কি লুকিয়ে নেই মানুষের পরিশ্রম, ধৈর্য? তাই, যাই খাদ্য হোক না কেন, প্লেটের খাবার ফেলে উঠে যাওয়ার আগে, নষ্ট করার আগে একবার সেই মানুষদের পরিশ্রমের কথা ভাবি – যে অনামি, অচেনা, অজানা মানুষের অমানুষিক পরিশ্রমে আমাদের প্লেটে খাদ্য আসে তাদের ধন্যবাদ জানাই, আর খাদ্য নষ্ট না করার পণ করি।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Travel and tagged , . Bookmark the permalink.

2 Responses to আস্পারাগাসের কথা (Asparagus)

  1. “এখানে প্রতিটি আস্পারাগাসের ডাটায় জড়িয়ে আছে প্রচুর মানুষের শ্রম, স্বেদ, অশ্রু।” – দারুণ আবেগি ও তথ্য সমৃদ্ধ একটা লেখা। অনেক ভালো লেগেছে পড়ে।

    শুভেচ্ছা রইলো। সবসময়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান