সুমুদ্র তীরের এই কান্ শহরটি একসময়ে ছিল ধীবরদের গ্রাম, পাথরে বাঁধানো পাহাড়ি সরু সিঁড়ি-গলি চলে গেছে প্রাচীন সেই পাহাড়ি গ্রামের দিকে – প্রায় চারশো বছর পুরনো এই পাহাড়ি গ্রামে আজও বংশ পরম্পরায় মানুষের বসবাস, জীবন যাপন। চার্চ, দুর্গ ক্যাসল ইত্যাদি নিয়ে পাহাড়ের উপরে বেশ সুন্দর শান্ত এক ঐতিহাসিক শহর গড়ে উঠেছে।
বছরের এক সময়ে চলচিত্র উপলক্ষে রুপোলী পৃথিবীর মানুষের আনাগোনায় জমজমাট হলেও, বছরের অন্যান্য সময়ে কিন্তু এই গ্রামের বাতাসে থমকে থাকে ঐতিহাসিক রহস্যময়তা, গম্ভীরতা, নির্জনতা – এখানে এলে দেখা যায় কি ভাবে এক শান্ত উজ্জ্বল ফরাসী সকাল ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভাঙ্গে, জেগে ওঠে, ব্যস্ত হয়।
পাহাড়ের উপরের কান্ এর পুরনো অঞ্চল Le Suquet কে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নতুন কান্ – যার চাকচিক্যে, আধুনিকতার পাশেও এই অঞ্চল তার নিজস্ব ঐতিহাসিক আবেদনে টুরিস্ট আকর্ষণ করে চলে – দু’পাশের স্থানীয় রেস্টুরেন্ট বা সুভেনিরের ছোট্ট দোকানের সজ্জা নজর কাড়ে। সাধারণত সমুদ্র শহরগুলোর চরিত্র প্রায় একই হয় – সমুদ্র তট ঘিরেই যত ব্যস্ততা, বিনোদন, টুরিস্টের আনাগোনা, কিন্তু কান্ এর এই পুরনো অঞ্চল কান্ সমুদ্র শহরকে অন্যান্য সমুদ্র শহর থেকে আলাদা করেছে। কান্-এর এক নিজস্ব ছন্দ আছে, এক নিজস্ব চটক আছে – আর সেই নিজস্ব আবেদন, চটকই কান্ শহরকে বিশ্বের কাছে আলোচনার বিষয় করে তোলে।
ঐতিহাসিক সেই সিঁড়ি-গলি পথ ধরে চলতে চলতে, গলির দুই পাশের বাড়ীর মানুষদের জীবন যাপনের ঝলক দেখতে দেখতে একদম উপরে পৌঁছে সমুদ্রের তীর ঘেঁসে বিস্তারিত আধুনিক কান্এর দৃশ্য তো টুরিস্টদের মুগ্ধ করেই। ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সকালে পাহাড়ের উপরে ক্যাসলের চত্বরে পৌঁছে, দূরে দৃষ্টি রাখি, দেখি আধুনিক কান্ শহরের গায়ে হালকা কুয়াশার চাদর কি ভাবে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
পুরনো ঘড়ি ঘর, চার্চ, ক্যাসলের পাশ দিয়ে পথ চলতে চলতে এক ঐতিহাসিক শহরকে দেখা, এখানের মানুষের জীবন ছবি দেখাই যে এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য। এখানে পথ চলতে চলতে দেখি ফরাসী ভদ্রলোক কিভাবে তার আদরের বেড়ালের গলার বেল্ট বেঁধে, বেড়ালকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে – বেড়াল কি আর কুকুরের মতো গলায় বেল্ট বেঁধে পথ হাঁটা পছন্দ করবে? সে তো ফরাসী ভদ্রলোকের ঘাড়ে চাপাই পছন্দ করবে – অগত্যা ভদ্রলোক বেড়ালকে ঘাড়ে করেই পথ চলেছেন।
চলার পথে এমনি নানান টুকরো ছবি, টুকরো স্মৃতি দিয়ে ভরে ওঠে আমাদের ভ্রমণ কথা, ভ্রমণ ছবি – যে ছবি জীবন পথের কোন এক হলুদ দুপুরে এক চিলতে মুচকি হাসি উপহার দেয়। ভ্রমণ যেন বেঁচে থাকাকে পূর্ণ করে, পৃথিবীর নানা কোণে নিজেকে এই ভাবে ছড়িয়ে দিতে দিতেই জীবন চলে জীবনের পথে, আসলে আমরা যখন কোথাও যাই, জীবনের একটু অংশ, একটু সত্ত্বা যেন সেখানেই রেখে আসি, সময় পেলেই সেই রেখে আসা টুকরো সময়কে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে পছন্দ করি – ভালো লাগে। আর সেখানেই বোধহয় ভ্রমণের সার্থকতা।