ফ্লোরেন্সে মিকেলেঞ্জেলোর স্মরণে (Michelangelo Square, Florence, Italy)

জানি না, এক দৈত্যাকৃতি ভাস্কর্য ‘David’ কে সৃষ্টি করে মিকেলেঞ্জেলো ঠিক কতটা উচ্ছ্বসিত, অভিভূত, আনন্দিত বা ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু, অতিকায় সেই সৃষ্টি কয়েকশো বছর পরেও মানুষকে আশ্চর্য করে, অবাক করে, মানুষ প্রশ্ন তোলে কি ভাবে একা ঐ মানুষটি কালজয়ী সৃষ্টি করে দিতে পারে। মিকেলেঞ্জেলোর জীবন কালের সময় থেকেই তাঁর অদ্ভুত শিল্প ক্ষমতা ঘিরে ইউরোপে নানান কিংবদন্তীর জন্ম হয় – কিছু কিংবদন্তি মানুষ তৈরি করেছে আবার কিছু তিনি নিজেও তৈরি করেছিলেন। তাই, তাঁর জীবনী আজও রীতিমত রহস্যময়।

মাত্র ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে মিকেলেঞ্জেলো ইউরোপের শিল্পের ইতিহাসের কালজয়ী দুই ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলেন – Pietà  ও David।  Pietà ভাস্কর্যে মৃত যীশুকে কোলে নিয়ে মাতা মেরীর দুঃখিত মুখ পাথরে খোদাই করে দিয়েছিলেন – যে মুখের বেদনা শতাব্দী কাল পরে, আজও মানুষকে ব্যথিত করে, ছুঁয়ে যায়।

আবার, গলিয়াথের সঙ্গে যুদ্ধের ঠিক আগে বীর নায়ক ডেভিডের ভাস্কর্যও ছিল মিকেলেঞ্জলোর জীবনের মহান সৃষ্টি – ‘ডেভিড’ মিকেলেঞ্জেলোকে তাঁর সময়ে ইউরোপের শিল্প জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বাইবেলের কিশোর নায়ক ডেভিডকে নিয়ে ইউরোপের বহু শিল্পী বহু শিল্প, ভাস্কর্য, ছবি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু, সেখানে যেন হিংসাকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল – সেই সব ছবিতে সাধারণত গলিয়াথের কাটা মুণ্ডু হাতে বা তরোয়ালে গেঁথে নিয়ে যুদ্ধ জয়ী ডেভিডের ছবি বা ভাস্কর্য তৈরি হয়েছিল।

মিকেলেঞ্জেলোর সেখানেই ছিল কালজয়ী দূরদর্শিতা – তাঁর শিল্পী হৃদয় সংকেত দিয়েছিল, যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে তাঁর শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাঁর শিল্পে রক্ত পাত বা হিংসাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। মানুষের দুঃখ, ভালোবাসা, মানুষের নিষ্পাপ সরল সৌন্দর্য, প্রেমই হবে ভবিষ্যতের শিল্পের ভাষা, মানব জাতির উদ্দ্যেশ্য। আর তাঁর সেই মহান শিল্পী সত্তার প্রকাশ ইউরোপের নানা কোণে প্রকাশ পায় – সিস্টিন চ্যেপেলের ছাদে তাঁর আঁকা ছবিতে, মাতা মেরীর দুঃখ প্রকাশে, দৈত্যাকার ডেভিডের বাঁকানো মুখে গলিয়াথের সঙ্গে যুদ্ধ পূর্ব রাগ, চিন্তা বা আশংকায় মিকেলেঞ্জেলো যেন কয়েক শতাব্দী আগেই মানুষের ভবিষ্যৎ এঁকে গেছেন। তাইতো, আজও ইউরোপ তাঁকে এক মহান শিল্পী, এক মহান আর্কিটেক্ট, এক মহান ভাস্কর, মহান ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে মনে রেখেছে। আজও তাঁর সৃষ্টিকে নতুন ভাবে সংরক্ষণের জন্যে নিত্য নতুন গবেষণা হয়ে চলেছে, থ্রি ডি ইমেজ প্রসেস করে ডেভিডের উচ্চতা মাপা হচ্ছে।

এক বিশাল শ্বেত পাথর কেটে তৈরি ডেভিডের দেহ সৌষ্ঠবের মধ্যে মিকেলেঞ্জেলো পুরুষের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করেছেন – ডেভিড শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক, ডেভিডের পাথুরে দেহে পুরুষের পেশির দৃঢ়তা ও কমনীয়তা দুই ফুটে উঠেছে – শোণা যায়, মানব দেহকে ভালো ভাবে জানার জন্যে রাতের গভীরে চার্চের কবর খুড়ে মৃতদেহ তুলে এনে কাটাচেরা করতেন – তাঁর এই রহস্যময় ব্যবহারের জন্যে অনেকে তাঁকে হত্যাকারীও বলতো। কিন্তু, পরে পৃথিবী জেনেছে তিনি ছিলেন শিল্পী।

তাঁর সমসাময়িকরা মনে করতো তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যেন সৃষ্টি কর্তার কোন এক সরাসরি সংযোগ আছে, তাই তো তাঁর নাম হয় – ডিভাইন মিকেলেঞ্জেলো। এমনকি, মিকেলেঞ্জেলো নিজেও হয়তো তা মনে করতেন, আর সেই মনোভাবের প্রকাশই বোধহয় সিস্টিন চ্যপেলের ছাদের সেই বিখ্যাত ছবি – যেখানে সৃষ্টি কর্তা আদমকে সৃষ্টি করেছেন, মাঝে রয়ে গেছে এক চুলের ব্যবধান।

পনেরো শতাব্দীর ফ্লোরেন্স ইউরোপের শিল্পের নবজাগরণের স্বর্ণ যুগে সবে পদক্ষেপ করছিল, ইউরোপের চারিদিক থেকে শিল্পীরা ফ্লোরেন্সে এসে জমায়েত হয়েছিল, আর শিল্প ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে একদম সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত ছিলেন মিকেলেঞ্জেলো, প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর অপূর্ব শিল্প প্রতিভা।

আর আজও ফ্লোরেন্স তাঁকে, তাঁর কাজকে যেন আরও বেশী করে ধরে রেখেছে, আগলে রেখেছে – তাঁর প্রমান এই Michelangelo Square, ফ্লোরেন্সে এসে সম্পূর্ণ ফ্লোরেন্সকে এক নজরে দেখে নিতে একবার এখানে আসতেই হয়। শিল্পীর শহর ফ্লোরেন্স, মিকেলেঞ্জেলোর কর্মভূমি ফ্লোরেন্স – এখানে এসে সম্পূর্ণ ফ্লোরেন্স শহরের আলোকিত বিস্তার দেখতে দেখতে রোমাঞ্চ জাগে মনে, ভালো লাগে। দূরের দিকে দেখে মনে হয় যেন এখানে রূপকথা জেগে উঠেছে।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, Italy, Southern-Europe, Travel and tagged , , . Bookmark the permalink.

1 Response to ফ্লোরেন্সে মিকেলেঞ্জেলোর স্মরণে (Michelangelo Square, Florence, Italy)

মশিউর রহমান মিঠু এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল