এক পলাশ রাঙা বসন্ত সকালে বাবাকে বলতে শুনেছিলাম – জানো, কাল রাতে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, দেখি আমার মৃতদেহ দাক্ষিণাত্যের সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তীরে এসে ঠেকেছে, কেউ নেই কাছে, আর অদ্ভুত আলোয় রাঙা রক্তিম ভোরের আলো এসে পড়েছে আমার মৃতদেহে। ভাবছি একবার দক্ষিণের সমুদ্রে ঘুরে আসবো।
না, বাবা আর দক্ষিণের সমুদ্র তীরে যাওয়ার সুযোগ পেল না, ঐ স্বপ্ন দেখার পনেরো দিনের মাথায় বাবা চলে গেল, মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়স, বাইরে থেকে দেখতে খুবই সুস্থ, ছয় ফুট উচ্চতার সুস্থ সবল চেহারার অধিকারী বাবা যে এই ভাবে হঠাৎ চলে যাবে ভাবি নি – উচ্চ রক্তচাপ ছিল, সেরিব্রেল অ্যাটাক মাত্র তিনদিন সময় দিয়েছিল বাবাকে। অনেক ছোট ছিলাম, মৃত্যুকে ঠিক বুঝিনি, মনে হত বাবা বুঝি দক্ষিণের সমুদ্র তীরেই গেছে।
তারপর তো কত দিন চলে গেছে, বহু পেছনে ফেলে এসেছি সেই পলাশ রাঙা সকাল, ধীরে ধীরে বুঝেছি জীবনের একমুখী যাত্রার সত্য, মৃত্যু যে এক অমোঘ সত্য তা জেনেছি। জানি না, মানুষ নিজের মৃত্যুকে নিজে জানতে পারে কিনা, শুনেছি দাদুও নাকি নিজের মৃত্যুর সময় বলে দিয়েছিলেন– বলেছিলেন, আমি বৈশাখে মারা যাবো, সত্যিই বৈশাখ মাসটি পেরোয় নি, দাদু মারা গিয়েছিলেন।
আমার বড় প্রিয়জনেরা এখন আমার স্মৃতির বাসিন্দা, আমার অন্তরের আরও কাছের মানুষ হয়ে গেছে তাঁরা। শেষ রাতে কন্যাকুমারীর সমুদ্র তীরে এসে এক দমকায় তাঁরা যেন ফিরে এলো আমার কাছে – সমুদ্রের জোলো হাওয়া হয়ে উড়িয়ে দিল আমার চুল। দূরে ভারতবর্ষের শেষ স্থলভূমি বিবেকানন্দ রকের উপরে বিবেকানন্দ মন্দিরে জ্বলা শেষ রাতের আলো এখনো জ্বলজ্বল করছে – আর সেই আলো সমুদ্রে ঠিকরে পড়ছে। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, নিঃশব্দে হাজার মানুষ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভোরের অপেক্ষা করছে।
দক্ষিণের সমুদ্র তীরে ভোরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে বাবার স্বপ্নের কথাই মনে হল – সত্যি জীবন এক অদ্ভুত খেলা, কখন যে খেলাঘরটি ছেড়ে মহাসিন্ধুর ওপারে পাড়ি দিতে হয় কেউই জানে না, শুধু একটি ডাকের অপেক্ষা – চলে আয় রে, চলে আয়।
ধীরে ধীরে ভোরের রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ল সমুদ্রের বুকে – ভোরের এই সময়টি বড়ই সুন্দর, আমার মনে হয় প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সময় ভোর ও সন্ধ্যা, এই দুই সময়ে প্রকৃতিতে এক অদ্ভুত আবেশ জড়ানো থাকে।
ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লে শীতের কুয়াশার আড়ালে দিগন্তের একটু উপরে টকটকে লাল সূর্যকে দেখা গেল – কন্যাকুমারীতে শুরু হল এক নতুন দিন, নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্খা, অঙ্গীকার। যেন জীবনের পথে এগিয়ে চলার জন্যে আরেক দিন উপহার দিল কন্যাকুমারী।