কয়েক বছর আগের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ বসনিয়া-হারজিগোভিনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কিন্তু পর্যটনের হাত ধরে খুবই দ্রুত নিজেদের পুরনো গৌরব, ঐতিহাসিকতাকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকটা ঠিক পুরনো ছিঁড়ে যাওয়া বইকে নতুন মলাটে সাজিয়ে নিয়ে সযত্নে সংরক্ষণের চেষ্টাও বলা যায়।
সামারে বসনিয়ার রুক্ষ বালকান পাহাড় শ্রেণীর খাঁজে বয়ে যাওয়া ফিরোজা রঙের নদীর মায়াবী বাঁক, রুক্ষ খাড়া পাহাড়ের বুকে মেষ পালকের মেষ পালনের দৃশ্য, ছবির মতো বসনিয়ার ছোট্ট গ্রাম – সবই আজ পৃথিবীর বহু টুরিস্টকে হাতছানি দেয় – অ্যাডভেঞ্চারের নেশা জাগিয়ে তোলে।
বলা যায়, আজ বসনিয়া ইউরোপের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় টুরিস্ট গন্ত্যব্য। প্রতি বছর বসনিয়া- হারজিগোভিনিয়াকে দেখার জন্যে বহু টুরিস্ট ইউরোপের এই আশ্চর্য কোণে পাড়ি দেয়। আর বসনিয়াও যেন তার বুকে ঘটে যাওয়া, বহুদিনের সত্যি মিথ্যের চাদর সরিয়ে পৃথিবীর ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের কাছে ধরা দেওয়ার জন্যে তৈরি হয়।
বসনিয়া ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত শহর প্লোস (Ploce) এ এসে যখন আমাদের বাস থামল – দূরে রুক্ষ পাহাড় ও সমতলে একটু আধটু চাষ ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না – বালকান পাহাড় শ্রেণীর রুক্ষতা যেন এই দেশের এক চাদর, এক উদাসীন রুক্ষ সৌন্দর্য।
প্লোস থেকে যখন বসনিয়ায় ঢুকে পড়লাম, বসনিয়ার সীমান্ত রক্ষীরা পাসপোর্টে ষ্ট্যাম্প দিতে দিতে জানাল – শীতে নাকি ঘন বরফের চাদরে মোড়া থাকে – তখন নাকি কোন টুরিস্ট ভুলেও এদিকে আসে না, খুবই ঠাণ্ডা পড়ে এই বালকান উপত্যকায়, রাস্তাও অনেক সময় বন্ধ থাকে।
মাঝ জুলাইয়ে তো এখানে ঠাণ্ডার ছিটেফোঁটা নেই, যেদিকে দু’চোখ যায় রুক্ষ নেড়া পাহাড় ও চাষের জমি, স্থানীয় মানুষের ছোট্ট ছোট্ট সুদৃশ্য ঘর বাড়ী, জীবন যাপনের অপূর্ব ছবি। প্রকৃতি ইউরোপের এই কোণকে অনেকটা পাহাড়ি রুক্ষ সৌন্দর্য, কিছুটা শ্যামলিমা, ফিরোজা নদীর চঞ্চলতা, চপলতা – সব দিয়েই সাজিয়েছে, আর বসনিয়াও টুরিস্টদের খুবই আপ্যায়ন করে, স্বাগত জানায়, বলে ওদের দেশের আকার ‘heart-shaped land’ – কথাটি হয়তো সীমান্তের আকার ছাড়াও দেশের মানুষের হৃদয়ের প্রসারতাকে বা উষ্ণতাকেও বোঝায়।
যুদ্ধ বিগ্রহ, হানাহানি – যা মানব সভ্যতার অতি কুৎসিত, পাশবিক এক দিক, আর অতীতের সমস্ত পাশবিকতা ভুলে, চোখের জল মুছে যখন স্বাধীন বসনিয়া নতুন দিনের ভোরে নিজেকে সাজিয়ে তুলছে, সারিয়ে তুলছে, তখন পৃথিবীর সমস্ত ভ্রমণ পিয়াসী মানুষেরা মুখ ফিরিয়ে থাকে কি করে – ওরা চায় বসনিয়ার মস্তারের ঐতিহাসিক গলির মোড়ে হারিয়ে যেতে, ওরা রাজধানী সারাজেভোর ভিড়ে মিশে হেঁটে যেতে চায় বহু দূর, এই রহস্যময় দেশটিকে আবিষ্কার করে নিতে চায় একটু একটু করে।