সেদিন নববর্ষের কয়েক ঘন্টা আগে, কণকণে ঠাণ্ডায় হাজার অচেনা মানুষের সঙ্গে প্যারিসের আলোকিত রাজপথ ‘Champs-Élysées’ ধরে হেঁটে যাওয়ার মধ্যেই বোধহয় ছিল সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বীজ, নতুনকে আহ্বান করে নেওয়ার উত্তেজনা, আনন্দ, উত্তাপ, আশা – কে জানে। Place de la Concorde থেকে Place Charles de Gaulle এর Arc de Triomphe পর্যন্ত প্রসারিত দীর্ঘ রাস্তা এই Champs-Élysées, প্যারিসের বুলেভার্ড – একে সম্পূর্ণ আলোর মালায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাস্তার দু’পাশের শীতের শুকনো গাছের ডালে আটকে দেওয়া হয়েছে আলোর মালা – দীর্ঘ পথটি অপূর্ব এক সামঞ্জ্যস্যময় আলোকিত পথে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বহু জায়গার মানুষ শুধু নব বর্ষের প্যারিস ও তার আলোক সজ্জা দেখতেই আসে। এ যেন আলোর এক আনন্দময় উৎসব।
আগেও, একবার প্যারিসে এসে দিনের বেলা Champs-Élysées ধরে হেঁটেছিলাম, দু’পাশে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্র্যান্ডের শো-রুম, দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট – সব মিলিয়ে এক জমজমাট চেহারা দেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু, নব বর্ষে ও ক্রিসমাসের মরশুমে এই বুলেভার্ডের চেহারা যে একেবারেই রাজকীয় হয়ে ওঠে জানা ছিল না। আর সেই অজানাকে জানার আগ্রহেই সেদিন ছিল আমাদের এই পথ চলা।
এই রাজপথ একসময়ে রাজার বাগান ছিল, কিন্তু আজ এই রাজপথ প্যারিসের জনজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, প্যারিসের বুকে ঘটে যাওয়া বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই ব্যস্ত রাজপথ।
হিটলারের কবল থেকে প্যারিস শহরকে মুক্ত করে মুক্ত ফ্রান্স ও মিত্রবাহিনীর সেনারা এই রাজপথ ধরে, Arc de Triomphe নীচ দিয়ে বিজয় যাত্রা করেছিল, আর রাজপথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে প্যারিসের সাধারণ মানুষ বিজয়ী সেনাদের অভ্যর্থনা করেছিল। ইতিহাসের সময় থেকে, প্যারিসে যখনই বড় মিলিটারি প্যারাড হয়েছে, সে শত্রু পক্ষের হোক বা মিত্র পক্ষের – এই রাজপথেই তা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এখনো, প্রতি বছর ১৪ জুলাই বাস্টিল ডে তে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মিলিটারি প্যারাড এই রাজপথেই অনুষ্ঠিত হয়। আর তাছাড়া, এই রাজপথের দু’পাশে পৃথিবীর সমস্ত দেশের, ফ্রান্সের নামী দামী দোকানের সজ্জা তো সমস্ত টুরিস্টের নজর কেড়েই নেয়। তাই প্যারিস এলে এই পথে একবার অন্তত না হাঁটলে প্যারিসের আসল জমজমাট, রাজকীয় চরিত্রটি অধরাই থেকে যায়।
ভিড়ের সঙ্গে মিশে আলোকিত Place de la Concorde থেকে রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে Arc de Triomphe কাছে পৌঁছে গেলাম, বোঝাই গেল না। Arc de Triomphe কাছে ভিড় আরও ঘন হয়েছে, আর ভিড় যেন বাঁক নিয়েছে। আর সামনে যাওয়া যাবে না, তাই সই, আমরাও ভিড়ের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করলাম।
জীবন থেকে একটি বছর ঝুপ করে খসে পড়ল। গেল বছরে কি পেলাম আর কি পেলাম না তার হিসাবটি বড়ই গোলমেলে – হিসাব মেলানো ভার, আয় ব্যয় একাকার। বছরের শেষ দিনে মনে হয় আরে, বছরটি এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো, বুঝতেই পারলাম না তো! কিন্তু, বছর ঘুরে যায় নিজের মতো করে, পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় শহরের রাস্তা ঘাট সেজে ওঠে, মানুষ সাজে, সেজে ওঠে তুলুসের গলি, পাড়া। মানুষের চোখে ফুটে ওঠে নতুন বছরের স্বপ্ন।
কিন্তু, সেবার যখন নববর্ষ বরণের জন্যে মাঝ রাতে জীবনের হিসাব লেখার খাতাটিকে বগলদাবা করে, প্যারিসের আলোকিত রাজপথে হাজার অচেনা মানুষের ভিড়ে মিশে পথ হেঁটেছিলাম, বর্তমান মুহূর্তটিই তখন অমূল্য হয়ে উঠেছিল, অপূর্ব হয়েছিল। পুরনো বছরের চাওয়া না চাওয়ার, পাওয়া না পাওয়ার গোলমেলে হিসাবের পাতাটি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে সিয়েন নদীর কালো জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।