অলিম্পিক খেলার সমারোহ যে কি বিশাল, রাজকীয়, উদার, সৌম, ঐশ্বর্যময়, প্রসারিত হতে পারে তার এক চমৎকার নিদর্শন দেখা যায় বার্সিলোনার Montjuïc পাহাড়ের অলিম্পিক পার্কে এসে। দূর থেকেই নজরে পড়ে অলিম্পিক পার্কের বিখ্যাত আকাশ ছোঁয়া টেলি কমুনিকেশনের টাওয়ারটি, অলিম্পিক খেলোয়াড়দের হাতে ধরা মশাল ও তার শিখার প্রতীক এই টাওয়ারের সুউচ্চ চূড়া। এই বিখ্যাত টাওয়ারকে ওরা আদর করে বলে Torre Telefónica ও Torre Calatrava। ১৩৬ মিটার উচ্চতার এই টাওয়ার বিরানব্বইের অলিম্পিকের সমস্ত খেলার টেলিভিসন সম্প্রসারণের জন্যে তৈরি হয়েছিল। টাওয়ারের নীচটি Gaudí র অনুকরণে, টুকরো টাইলস দিয়ে সাজানো।
প্রধান হাঁটার রাস্তাটি বাঁধানো ও দু’পাশে সারি বাঁধা থাম ও সম্পূর্ণ চত্বরটি অলিভ গাছ দিয়ে সাজানো। সন্ধ্যা হলে মৃদু আলোয় থাম গুলো জ্বলে ওঠে, রাস্তা দেখায়। শেষ বিকেলে প্রচুর মানুষ সেই পথ ধরে হাঁটে, অলিম্পিক পার্কের বিশালতাকে, উদারতাকে, মহানুভবতাকে অনুভব করে।
বিরানব্বই অলিম্পিকের সমস্ত প্রধান খেলার জায়গাই ছিল এই পার্ক। অলিম্পিক খেলা যে দেশে হয়, সেই দেশ যেন তার নিজের দেশের ঐশ্বর্য, রুচি, ক্ষমতা, শিল্প চেতনা সবই জাহির করে দেয় বিশ্বের কাছে, বিশ্বের খেলোয়াড়দের কাছে। তৈরি হয়ে যায় বিশাল স্টেডিয়াম, সাঁতারের পুল আরও কত খেলার জায়গা। সারা বিশ্বকে আপ্যায়ন করতে তৈরি হয় সেই জায়গা – সে এক বিশাল রমরমা, জম জমাট ব্যাপার। আর সেই জমজমাট সমারোহের ছোঁয়া কিন্তু এখনো রয়ে গেছে এখানে, শুধু সেই খেলোয়াড়রা নেই – কিন্তু এখন প্রচুর মানুষ সেই সমারোহের অবয়ব দেখতেই, এসে হাজির হয় Montjuïc পাহাড়ের কোলে।
বিরানব্বইয়ের অলিম্পিক খেলার মহান যজ্ঞের সেই হাজার মানুষের আনন্দ, হেরে যাওয়ার অশ্রু, জেতার আনন্দ, হাজার দর্শকের চিৎকারের অনুরণন যেন এখনো থমকে আছে এখানের পরিবেশে। সেই স্মৃতি বহন করে ফেরে এই বিশাল পার্ক ও পার্কে আসা বার্সিলোনার মানুষ। এখনো এখানে অনেক স্থানীয় খেলা হয়, অনেকে পার্কের রাস্তায় দৌড়তে আসে। কিংবা এই পার্কে শুধুই হাঁটাও খুবই মনোরম।
শেষ বিকেলে যখন এখানে এলাম, সূর্য Montjuïc পাহাড়ের ওপারে, আর শেষ বেলার হলুদ কমলা আলো ভাসিয়ে দিচ্ছে টাওয়ার ‘Torre Telefónica’ ও শেষ বেলার আলোয় টাওয়ারের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে বিশাল চত্বরে। শুনেছি, এই টাওয়ার নাকি এক অতিকায় সূর্য ঘড়ির কাজ দেয়, আর Europa স্কোয়ারে এই ছায়া দেখে অনেকে সময় আন্দাজ করে নেয়।
অলিম্পিক পার্কের পথে হাঁটতে হাঁটতে Montjuïc পাহাড়ের ওপারে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যায় মন। মনে হয়, পৃথিবীর বুকে আমরা যেন এক একটি দাবার ঘুটি, কেউ একজন অদ্ভুত ভাবে চাল দিয়ে চলেছে, কখন কোন ঘরে এনে ফেলবে কেউই জানে না। ঘুটি যতই নিজে হাত পা ছুরুক, চাল কিন্তু অন্য এক খেলোয়াড়ই দেয় – আর কোন চালে কিস্তিমাত, কোন চালে খেলার বাইরে, কেউই জানে না। বিরানব্বইয়ে তো এক্কেবারেই জানতাম না এখানে একদিন চলে আসবো, অলিম্পিক পার্কে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবো। এমনকি, মারী কমও বোধহয় বিরানব্বইয়ে জানত না – অলিম্পিকে মেডেল পাবে। তবে চাল যেই দিক না কেন – মানুষের হৃদয়ে স্বপ্নরা বীজ বুনে যায়, আর সেই স্বপ্নই হারিয়ে দিতে পারে সেই চালবাজ খেলোয়াড়টিকে, কিংবা হারাতে না পারলেও হারানোর স্পর্ধা করে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাল বলদেও দিতে পারে।