শতাব্দী ধরে কত স্প্যানিশ ও আন্তর্জাতিক সুর শিল্পীর সুর লহরীতে ভরে উঠেছে এই কনসার্ট হলের প্রতিটি কোণা, উপস্থিত দর্শক-স্রোতার হাততালির ঝড়ে ধন্য হয়েছে শিল্পীরা। বার্সিলোনা এসে শহরের ব্যস্ত গলির মধ্যে এই স্থাপত্যের উপস্থিতিকে কেউই এড়িয়ে যেতে পারে না।
এই স্থাপত্য তৈরির সময় স্পেনের কাটালুনিয়া অঞ্চল modernista বা আধুনিকতার জোয়ারে ভাসছিল। তাই স্পেনের এই স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল Catalan Art Nouveau স্টাইলে। আর Catalan Art Nouveau স্টাইলের নিদর্শন এই স্থাপত্য, ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
এই স্থাপত্য শুধু যে ইট, লোহা, পাথর, কাঁচের তৈরি এক স্থাপত্য তা নয় – এই স্থাপত্যে স্পেনের কাটালুনিয়া অঞ্চলের মানুষের শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও বেঁচে থাকার আবেগ জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে এখানের মানুষের সঙ্গীত চেতনা।
সাধারণত ইউরোপের কনসার্ট হলে পাইপ অর্গান থাকে না, চার্চেই সাধারণত বিশাল পাইপ অর্গান শোভা পায়, কিন্তু এই হলের এক পাশে বিশাল পাইপ অর্গানের উপস্থিতি একে ইউরোপের অন্যান্য কনসার্ট হল থেকে শুধু আলাদাই করে নি, কনসার্ট হলের চরিত্রকে আপাত বিরোধীও করেছে। যেহেতু, স্পেনের কাটালুনিয়া অঞ্চলের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা Orfeó Català choral সোসাইটির জন্যে তৈরি হয়েছিল এই কনসার্ট হল, তাই এই পাইপ অর্গান রয়ে গেছে এই কনসার্ট হলের এক দিকে।
আশ্চর্য, সুন্দর, রহস্যময় এই কনসার্ট হলের ছাদে একদম মধ্যে খানে রঙিন কাঁচের তৈরি গোলাকার বিশাল এক স্কাই লাইট দিয়ে ভেতরে ঢোকে দিনের আলো। অলংকৃত গোলাকার এই স্কাইলাইট সূর্যের প্রতীক। সম্ভবত এটাই ইউরোপের একমাত্র কনসার্ট হল যেখানে দিনের বেলা সূর্যের আলো সম্পূর্ণ ভাবে আলোকিত করে তোলে কনসার্ট হলের ভেতর। হলের ভেতরে প্রতিটি থামের গায়ে গায়ে সাজানো নানান আকারের সুদৃশ্য স্ট্যাচু – ভেতরে কেমন যেন এক রূপকথার স্বপ্ন পুরীর আলো আঁধারময় এক রহস্যময় পরিবেশ থমকে আছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এই স্থাপত্য সম্পদের উপস্থিতি, কাটালুনিয়ার মানুষকে গর্বান্বিত করেছে। প্রতিদিন এই কনসার্ট হল দেখতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ ভিড় করে এখানে। এই কনসার্ট হলের ভেতরে আবার নানান ছোট ছোট হলও আছে। এখানে নানান হলের অলংকৃত সিঁড়ির মোড়ে মোড়ে হাজার দর্শকের কৌতূহলী পদক্ষেপে আলোড়িত হয় এই অপূর্ব কনসার্ট হল বিল্ডিং।
দু’হাজারের উপর মানুষের বসার আয়োজন আছে এখানে। ভেতরে ধাপে ধাপে সাজানো খালি চেয়ারে যেন থমকে আছে অতীতের শূন্যতা, কিংবা অনাগত ভবিষ্যতের প্রতীক্ষা।
শতাব্দী আগে, অতীতের কত মানুষের ধৈর্য, শিল্প বোধ, ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান, স্থাপত্য বিদ্যা, অধ্যবসায় দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ধরণের ঐতিহাসিক নিদর্শন। পৃথিবীর বুকে মানুষের সংস্কৃতির সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও থাকবে এই সঙ্গীত প্রাসাদ – আর পৃথিবীর বুকে মানব জাতির অনন্ত পথ চলার এই সাক্ষরের সামনে দাঁড়িয়ে, আশ্চর্য হই, ভালো লাগে, নিজেকে ধন্য মনে হয়। পুরো কনসার্ট হল ঘুরে দেখতে দেখতে, অতীতের এই রহস্যময় পরিবেশে এসে মনে হয়, পৃথিবীর বুকে মানুষের পথ চলা বড়ই আশ্চর্যের, এই পথ চলার প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে হাজার চমক।