মাঝ অক্টোবরের হাড় হিম কণকণে ঠাণ্ডা, মেঘলা আকাশ, ধূসর বিকেল নামছে কোপেনহেগেন শহরের বুকে। আর আমরা সমুদ্রের তীরের জনহীন বিশাল পার্কের এক প্রান্তে হেঁটে চলেছি – উদ্দ্যেশ্য কোপেনহেগেনের তারা দুর্গ ‘Kastellet’ বা ‘the citadel’। Kastellet উত্তর ইউরোপের অন্যতম সংরক্ষিত তারা দুর্গ।
পাঁচ কোণাকৃতি এক তারার মত এই দুর্গের উঁচু সুরক্ষা দেওয়াল, ও ভেতরে সতেরো শতাব্দীর তৈরি মিলিটারি ব্যারাক, চার্চ – তবে জন সাধারণের জন্যে খোলা। সুরক্ষা দেওয়ালের উপরে চলে গেছে সবুজ ঢালু রাস্তা। অবশ্য এখন এই Kastellet কোপেনহেগেনের অন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণ, ও স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন বৈকালিক ভ্রমণ ও দৌড়নোর জায়গা।
এখন এই জায়গায় মানুষ শুধু যে ঐতিহাসিক স্থাপত্যের আকর্ষণে আসে তা নয়, আমার মনে হয় স্থানীয় মানুষকে প্রতিদিন এই বিশাল জায়গার প্রচুর সবুজ প্রকৃতির টানেই আসতে হয়, এখানে কিছু সময় কাটায় প্রকৃতির কাছাকাছি, দিনের শেষে সবুজের মধ্যে হেঁটে জীবনী শক্তি ফিরে পায়।
তবে এই শীতের এই ধূসর বিকেলে খুব একটা লোক দেখা যাচ্ছে না, যে দু এক স্বাস্থ্য সচেতন লোক দেখছি, খুবই দ্রুত দুর্গের দেওয়ালের উপরের ঢালু সবুজ রাস্তা ধরে দৌড়ে চলেছে।
সতেরো শতাব্দীতে এই Kastellet দুর্গের দেওয়াল কোপেনহেগেন শহরের সুরক্ষা দেওয়ালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কোপেনহেগেনের ইতিহাসে এই দুর্গের প্রচুর অবদান ছিল – উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ডেনমার্কের যুদ্ধে এই দুর্গ সুরক্ষা দিয়েছিল, আবার দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জার্মানরা এই দুর্গ দখল করেই ডেনমার্ককে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করেছিল।
যদিও, এখন এই জায়গায় মিলিটারিদের নানা কার্যকলাপ হয় কিন্তু, এই জায়গা মূলত জন সাধারণের পার্ক। এখন Kastellet দুর্গের সীমানার যে টুকু অংশ সংরক্ষিত আছে, তার ভেতরে পুরনো দিনের লম্বা টানা লাল রঙের বিল্ডিং, চার্চ ,উইন্ড মিল, ও প্রচুর হলদে হয়ে যাওয়া গাছ এই জায়গার শোভা বাড়িয়েছে।
এক খালের উপর দিয়ে দুর্গের দিকে কাঠের ব্রিজ চলে গেছে, ব্রিজ পেড়িয়ে দুর্গের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কেমন যেন এক অতি পুরনো অচেনা পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় হয়। শীতের স্তব্ধ সন্ধ্যায় কেমন এক নিঃসঙ্গতা জড়িয়ে আছে এই জায়গার বিশাল লাল বিল্ডিঙে, ছোট্ট চার্চ আর সামনের খোলা জমিতে। কবল স্টোনে বাঁধানো বিশাল খোলা চত্বরে যেন ছড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক শীতলতা।
বিশাল এই এলাকায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেন শেষই হতে চায় না। আমাদের আবার রাত নটায় ফেরার ট্রেন, দ্রুত বিশাল এই চত্বরে ফেরার পথ খুঁজে শহরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার পথ গেল হারিয়ে।
সামনেই একজনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করতে সে দু’টো রাস্তা বলে দিল – এক একটু হেঁটেই শহরের ভেতর দিয়ে – ষ্টেশন, আরেকটা পথ চলে গেছে পার্কের মধ্য দিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম – কোন পথ দিয়ে আগে ষ্টেশনে পৌঁছতে পারবো। সে জানালো – যদি আমাকে ষ্টেশনে যেতে হয় আমি পার্কের ভেতর দিয়ে যাওয়াই পছন্দ করব, তোমরাও শহরের ভিড়ের মধ্য দিয়ে না গিয়ে পার্কের রাস্তা ধরে যাও, তোমাদের ভালো লাগবে।
নির্জন হলুদ সবুজ পার্কের পথে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে আশপাশের সৌন্দর্য শেষ বারের মতো দেখে নিতে কিন্তু ভুলিনি। আজও কখনো ভোর রাতে স্বপ্নের ঘোরে পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত, কোপেনহেগেনের বিশাল এক ঐতিহাসিক দুর্গের কোন এক বিশাল হলুদ সবুজ, শীতল পাথুরে চত্বরে নিজেকে আবিষ্কার করি।