কোপেনহেগেন শহরের একদিকে সমুদ্রের ধার ঘেঁসে বিশাল পার্ক Langelinie তে এসে দিক ভুল হতেই পারে, আর দিক ভুল করে হাঁটলে প্রতিটি পদক্ষেপে শহর থেকে দূরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। তবে কোপেনহেগেনের জলপরীকে দেখতে শহর ছাড়িয়ে, পার্ক ছাড়িয়ে প্রচুর হাঁটতে হয়, বিশাল পার্কে অক্টোবরের শীতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতেই পারে সত্যি জলপরী আছে তো? ঠিক দিকে যাচ্ছি তো?
তাই, কিছুদূর হেঁটে পার্কের জন মানবহীন এলাকায় চলে এসে, আর পার্কের ভেতরের কোন ম্যাপ আমাদের সঙ্গে না থাকায় একটু দিগ্ভ্রান্তই হয়ে যাই। দূরে সাইকেল নিয়ে এক ভদ্রমহিলাকে এদিকেই আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম – লিটিল মারমেড কোন দিকে? সাইকেল থেকে নেমে মিষ্টি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন – তোমরা তো সম্পূর্ণ ভুল দিকে হাঁটছ। কিছুদূর আমি ঐ দিকেই যাব। এসো আমার সঙ্গে।
ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন – কোন দেশ? আমরা – ‘ইন্ডিয়া’ বলতেই, তিনি অন্তরঙ্গ সুরে বললেন – ‘এই তো আমি কিছুদিন আগেই দু’মাস ইন্ডিয়াতে কাটিয়ে এসেছি। কোলকাতা, কেরালা, পন্ডিচেরি। কলকাতায় মাদার টেরেজার আশ্রমে গেছি। খুব ভালো লেগেছে।’ তারপর হাঁটতে হাঁটতে এ কথা সে কথায় পার্কের এক তিন মুখো রাস্তায় এসে এক রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলে দিলেন – এই রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে তোমরা কোপেনহেগেন বন্দরে পৌঁছে যাবে। তারপর, সমুদ্রের ধারের রাস্তা ধরে অনেকটাই হাঁটতে হবে। একদম শেষে পাবে আমাদের লিটিল মারমেডকে।
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বিশাল পার্কের সমস্ত গাছের পাতা গুলো ঝরে যেতে যেতে হলুদ-কমলা রং ধরেছে, তাই ধূসর মেঘলা দিনের ছবি একটু হলেও রঙিন হয়েছে। ঠাণ্ডায় বিশাল পার্ক খালিই বলা যায়। যে কয়েক জন চোখে পড়ে – টুরিস্ট বলেই মনে হয়।
ব্রোঞ্জের তৈরি ছোট্ট লিটিল মারমেড স্ট্যাচুটি কোপেনহেগেনের সবচেয়ে আলোচিত ও আদরের এক টুরিস্ট আকর্ষণ। যে কোন টুরিস্ট কোপেনহেগেন এসে লিটিল মারমেডকে না দেখে ফেরে না।
ডেনিশ সাহিত্যিক Hans Christian Andersen এর লেখা বিখ্যাত এক রূপকথার চরিত্র এই দুঃখী জলপরী। রুপকথায় প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে জলের নীচ থেকে উঠে এসে সমুদ্রের ধারে অপেক্ষা করে স্থলের রাজকুমারের জন্যে। রাজকুমারকে যে জলপরী ভালোবাসে রাজকুমার সেটা জানেই না, সে ভালোবাসে আরেক রাজকুমারীকে। তাই মনের দুঃখে জলপরী জলের ধারে চুপ করে বসে আছে আজও। গত একশো বছর ধরে এই জলপরী বার বার মানুষের হিংসার শিকার হয়েছে – অনেকবারই হাত ও মুণ্ডুহীন জলপরীকে দেখা গেছে, কিন্তু, প্রতিবারই জলপরীকে ঠিকঠাক করে পুনরায় জলের ধারেই স্থাপন করা হয়েছে।
বন্দরের পথে অনেকটা পথ হেঁটে যখন জলের ধারে দূরে এক জটলা দেখা গেল, বুঝলাম জলপরী সেখানেই আছে। জলপরীর সঙ্গে ফটো তোলার জন্যে লম্বা লাইন। অবশ্য জলপরীর আকার দেখে অনেকেই বলাবলি করছে – এতো ছোট স্ট্যাচুর জন্যে এতোদূর এলাম?
জলের ধারে পাথরের উপরে বসা বিরহ কাতর জলপরীর সঙ্গে অক্টোবরের ধূসর শেষ বিকেলের পটভূমি যেন মিশে গেছে। জলপরী আজও বসে আছে কোপেনহেগেনের সমুদ্রের কিনারে, পৃথিবীর বুকে যতই রং বদল হোক না কেন রাজকুমারের জন্যে তার প্রতীক্ষা অনন্ত কালের।