ইতালিতে বেড়ানোর যে কোন গাইড বই খুললে নেপলসের শহুরে জীবন সম্বন্ধে বেশ দুর্নামই পাওয়া যায়। টুরিস্টদের পকেটমারি, বা ছোট খাটো চুরি ছিনতাই নাকি এখানের নিত্য দিনের ঘটনা। তাই, এই শহরে পা রাখা মাত্রই বেশ সাবধান, সতর্ক হয়েই ঘোরা ফেরা করছিলাম। এমনকি বাসের ভেতরেও দেখেছি ‘পকেটমার হইতে সাবধান’ মূলক সতর্ক বানী লেখা। অবশ্য এই সতর্কবানী ইতালির অন্যান্য জায়গার বাসেও দেখেছিলাম। এখানে মহিলারা সবাই দেখি নিজের ব্যাগটি সামনের দিকে নিয়ে ঘোরে।
ইউরোপের পকেটমারদের শুধু যে হাত যশ আছে তা নয়, টেকনোলজিক্যালিও ওরা অনেক এগিয়ে। ইউরোপে তো আমার বেশ কয়েক জন বন্ধুরই পকেটমারি হয়েছিল। নোবেল লরিয়েটদের কনফারেন্সে জার্মানির লিন্দাও এ গিয়ে মোহিত হয়ে বন্ধুটি বেশ খোশ মেজাজেই ঘুরছিল জার্মানির নানা শহরে। বার্লিনে পা রাখা মাত্রই কি ভাবে যে পার্সটা পকেটমারি হয়ে গেল ও বুঝতেই পারল না। তারপর তো পিন নম্বর না জেনেও পকেটমারটি অদ্ভুত উপায়ে বন্ধুটির এ টি এম কার্ড দিয়ে ইউরো উঠিয়ে নিয়েছিল।
আবার, আমাদের খুবই কাছে এক বন্ধুর তো পিসার বাসে কি ভাবে যে পকেটমারি হয়ে গিয়েছিল – বেচারা, বিদেশ বিভূঁইয়ে বেশ বিপদেই পড়েছিল। পুলিশের কাছেও গিয়েছিল সে। পুলিশ নাকি হেসে বলেছে, তোমার টাকা ফিরে পাবে না, তবে যে বাসস্টপে নেমেছ সেখানের আশেপাশে খুঁজে দেখো। তোমার পাসপোর্ট ও কাগজপত্র সহ পার্স পেয়ে যাবে। বন্ধুটি ঠিকই ডাস্টবিন থেকে টাকা শূন্য পার্স ও পাসপোর্ট ফিরে পেয়েছিল।
পকেটমারের কথা বলতে গিয়ে আরেক বন্ধুর কথা মনে এলো – প্যারিসের ভরা মেট্রো ট্রেন থেকে মূল্যবান কাগজ, পাসপোর্ট, ফ্রান্সে থাকার ভিসা কার্ড ‘তিত্রে সেজুর’, এ টি এম কার্ড ও তার পাসওয়ার্ড, ইউরো সহ ব্যাগ চুরি হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুটির চোখের সামনেই ব্যাগটি বগলদাবা করে এক মেট্রো ষ্টেশনে নেমে যায় চোরটি, আর মেট্রোর দরজা বন্ধ হয়ে মেট্রো ছেড়ে দেয়। হতবাক বন্ধুটি শুধু তাকিয়েই থাকে – চোর বলে চিৎকার করারও সুযোগ পায় না। ট্রেনটি তো ততক্ষণে গতি নিয়ে নিয়েছে। বিষণ্ণ বন্ধুটি যখন নতুন পাসপোর্টের জন্যে আবেদন করে অপেক্ষা করছে, সেই সদয় ও ভদ্র চোরটি বন্ধুটির সমস্ত দরকারি কাগজপত্র সহ পাসপোর্ট ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপের ছিঁচকে চোরদের আবার শালীনতা ও ভদ্রতাবোধ প্রচণ্ড! বিদেশী পাসপোর্ট দেখে হয়তো আরও ফিরিয়ে দিয়েছে। আবার হয়তো বা, ছিঁচকে চোরেরা বিদেশিদের কাছে পকেটমার হিসাবে নিজেদের দেশের বদনাম হতে দিতে চায় না।
যাইহোক, খুবই ঘন বসতি পূর্ণ এই ইউরোপিয়ান শহরে বাংলায় কথা বললে, পথ চলতি পাশের লোকটি বাংলায় উত্তর দিলে আশ্চর্য হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন নেই। এখানে প্রচুর বাঙালি। এখানে, এক টেলিফোন বুথ থেকে বাংলায় কথা সেরে বেরনোর সময় ফোন বুথের মালিক বাংলায় আমাদের সাবধান করে বললেন – এখানে কিন্তু খুব পকেটমারি হয়। সাবধানে ঘোরাফেরা করবেন। আমিও পেটের কাছে ব্যাগ দেখিয়ে বললাম – জানি, এই তো সব এখানে সাবধানেই রেখেছি। রীতিমত, নেপলসের সমস্ত পকেটমারদের খোলা পকেটমারির নিমন্ত্রণ জানিয়ে বুথ থেকে বেরিয়ে এলাম। পশ্চিমবাংলার বাসে, ট্রামে চড়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তাঁদের নেপলসের পকেটমারির ভয় পাওয়া মানে তো লোক হাসানো ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে, সাবধানের মার নেই। ইউরোপের পকেটমার বলে কথা!
এই শহরে এসে বেশ আমাদের বেশ ঘরোয়া বলেই মনে হওয়ার কথা। নোংরা রাস্তাঘাট, নোংরা ফুটপাথ, যত্র তত্র কাগজ ও প্ল্যাস্টিক ছড়ানো, রাস্তায় বিশৃঙ্খল যানবাহন, প্রচুর মানুষের ভিড়, ট্র্যাফিক জ্যাম, ট্র্যাফিকের লাল বাতির নিয়ম না মানা প্রচুর স্কুটারের এলোমেলো গতি, যে কোন দিক থেকে গাড়ি চলে যাওয়া, জেব্রা ক্রসিঙে পথচারীদের দেখেও গাড়ির গতি না কমিয়ে হুঁশ করে চলে যাওয়া, অস্থিরতা, গতি, শহুরে বিশৃঙ্খলা – সবই আমাদের খুবই চেনা, অতি সুপরিচিত।
রাস্তায় প্রচুর হকার। স্যুভেনির, বড় বড় ব্র্যান্ডের ঘড়ি, চশমা, লেডিস ব্যাগ থেকে শুরু করে সমস্ত জিনিসই দেখি ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে – ওরা কিন্তু দাবি করে ব্র্যান্ডের আসল জিনিসই বিক্রি করছে। ভুলেও যদি কোন টুরিস্ট ওদের জিনিসের দিকে তাকায় ও কেনে ব্যস ঠকে যাওয়া অবশ্যাম্ভাবি। তাই, নেপলসের পথে চলতে চলতে যতই নির্মোহ হওয়া যায় ততই মঙ্গল।
তবে, রোম ও মিলানের পরে ইতালির সবচেয়ে ঘন বসতি পূর্ণ এই শহরের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বহু পুরনো ঐতিহাসিক রহস্য। ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এখানে মানুষের জীবন যাপনের নানা গল্প, চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। এই শহরের স্থাপত্যে জড়িয়ে আছে ইতালির অতীত মানুষদের জীবন যাপনের ছাপ। তাই ইতালি এসে, নেপলসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সৌন্দর্যের টানে একবার আসতেই হয়।
শুধু কি ঐতিহাসিক গুরুত্ব? প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়েও যে এই শহর পরিপুষ্ট। ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরিকে পেছনে রেখে মেডিটেরিয়ান তথা ইতালির অন্যতম সবচেয়ে বড় বন্দর এই নেপলস বন্দর। ভোরের আলোয় নেপলস বন্দরের দৃশ্যে মুগ্ধ হতে বাধা নেই। মেডিটেরিয়ান সমুদ্রের বুকে নেপলস বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল ক্রুজ লাইনার যেন এই শহরের দৃশ্যে সৌন্দর্য যোগ করে। তাই, অনেক টুরিস্ট ভোরের দিকে বন্দরের পথে হেঁটে সেই নির্ভেজাল সৌন্দর্যকে উপভোগ করে। আমরাও সেই পথে পা বাড়াই।