সিয়েন নদীর পাশের বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্যারিসকে দেখি। অনুভব করি এই শহরের হালকা মিষ্টি সুবাসিত বাতাস, দিনের অদ্ভুত উজ্জ্বল মায়াবী আলো। দেখি মানুষের হাসি আনন্দ। চলতে চলতে শুনি রাস্তার পাশের ভিখারিটির বাদ্য যন্ত্রে বাজানো অদ্ভুত সুরেলা সুর। মন এক ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। ফ্যাশন, শিল্প, স্থাপত্য শিল্প, ব্যবসা, সাহিত্য, জ্ঞান বিজ্ঞান সব বিষয়ের স্বর্গ ভূমি এই প্যারিস। ভালো লাগে এই শহরের হৃদ স্পন্দনের ছন্দে তাল মিলিয়ে পথ চলতে। এই শহর যত না ফরাসীদের, তত বেশী বিদেশী টুরিস্টদের।
সিয়েন নদীর উপরে বেশ কয়েকটা সেতু আছে। কয়েকটা সেতু শুধুই পথচারীদের জন্যে। ল্যুভরে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়েই কিছুদূরের মধ্যেই আছে Pont des Arts বা Passerelle des Arts সেতু। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ইচ্ছায় ১৮০৪ এ তৈরি প্যারিসের প্রথম লোহার ব্রিজ। ল্যুভরের চত্বর কে Institut de France এর সঙ্গে জুড়েছে এই সেতু।
পথ চারিদের জন্যে তৈরি সেতু গুলোকে ঠিক সেতু না বলে এক খোলা আর্ট গ্যালারি বলা যেতে পারে। শহুরে ব্যস্ততার মাঝেও মগ্ন শিল্পীরা এঁকে চলেছে তাঁদের মাস্টার পিস ক্যানভাস – তুলির টানে টানে প্যারিসের তেল ছবি ফুটে ওঠে তাঁদের ক্যানভাসে। পথচারীদের পথ চলা, ফটো তোলা তাঁদের মনোযোগে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারে না। একেই কি বলে সাধনা? আর সেই ছবির প্রদর্শনী হয় সেতুর রেলিং-এ।
প্যারিস ভালোবাসার শহর বলেই বোধহয় সেতুর রেলিং গুলো ভালোবাসার চিহ্ন বয়। Pont des Arts সেতুর রেলিং এর হাজার হাজার তালা সেই অবিনশ্বর ভালোবাসার গল্প বলে – এখানের এক একটি তালা এক একটি প্রেম কাহিনী। এই সেতুর রেলিং-এ কত যুগ ধরে যে এই তালা ঝোলানোর রীতি চলে আসছে তার খোঁজ কে রাখে। এখানে এসে রেলিং এ দু’জনে মিলে তালা মেরে, চাবি সিয়েন নদী গর্ভে ফেলে দেওয়াই নিয়ম।
নদী গর্ভে চাবি ফেলা ও রেলিং এ তালা ঝোলানো নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছে। প্যারিস শহর কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা বলছে যে রেলিং এ ঝুলন্ত অসংখ্য তালা সেতুর ওজন বাড়িয়ে দিচ্ছে, ফলে ব্রিজের খুবই ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া দীর্ঘদিনের পুরনো তালা মরচে পরে পরে সিয়েন নদীর জলে মিশে নদীর জল দূষিত করে তুলছে। কিছুদিন আগে তালার ভারে সেতুর রেলিংএর এক অংশ ধসে পরে। তাই, প্যারিস শহর কর্তৃপক্ষ কড়া পাহারাদার নিযুক্ত করেছে। পুরনো তালা সহ রেলিং সরিয়ে নতুন রেলিংএর ব্যবস্থা হয়েছে।
কিন্তু, ভালোবাসার শহরে ভালোবাসার এই চিহ্ন মুছে যাবে? কি করে সম্ভব, প্যারিসের এক ছাত্র প্যারিসের দুই সেতু Pont des Arts ও Pont de l’Archevêché এর সমস্ত love locks এর ফটো তুলে এক ওয়েব সাইট তৈরি করেছে। প্রায় সাতান্ন হাজার love lock এর ফটো আছে সেই ওয়েব সাইটে। তাই যারাই প্যারিসের সেতুতে love lock লাগিয়েছিল, ঐ ওয়েব সাইটে ওরা নিজেদের ভালবাসার বন্ধন ঠিকই খুঁজে পাবে। এই ধরণের আবেগ প্যারিসেই সম্ভব। এই শহর সমস্ত আবেগকে স্থান দেয়, লালন করে, প্রকাশ করে।