পর্তুগালে জুলাই মাসের প্রতিটি দিনই যেন খুব উজ্জ্বল সোনায় মোড়ানো। বাতাসে এক ফুরফুরে ছুটির আমেজ। লিসবন ছাড়িয়ে ট্রেনে প্রায় চল্লিশ মিনিট দূরে শহরের বাড়ী ঘর ছাড়িয়ে হঠাৎ নীল সমুদ্র উঁকি দিতেই মনে হল এখানেই নেমে পড়লে কেমন হয়? সমুদ্রের পাশেই এই ছোট্ট ষ্টেশনে ট্রেনটি আবার থেমেও গেল। ষ্টেশনের নামটি ‘Estoril’ পড়ে নিয়ে, নামবো কি নামবো না ভাবতে ভাবতেই দেখি ট্রেন আবার গতি নিয়েছে। এবার সমুদ্র ও তার পার্শ্ববর্তী বিনোদনের পসরা আমাদের সঙ্গেই ট্রেনের বাঁদিকে চলেছে। দেখতে দেখতে পরের স্টেশন ‘Cascais’ চলে এলো, খুবই কাছে। এবার আর দেরি না করে নেমেই পড়লাম, ঠিক করে নিলাম এখান থেকে হেঁটে Estoril যাব।
ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে শহরের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ছোট্ট Cascais শহরের পরিষ্কার পথ সাদা কালো পাথরে এক নক্সা করে বাঁধানো। প্রচুর ছোট ছোট কাফে রেস্টুরেন্ট, সুন্দর বাড়ী দিয়ে ছবির মতো সাজানো এই ছোট্ট শহরের জীবন যাত্রা। সকালের ছন্দে একটু একটু করে জেগে উঠছে এই শহর।
Estoril থেকে Cascais পর্যন্ত সমুদ্রের পাশের রাস্তা পাথরে বাঁধানো, এক স্বপ্ন সুন্দর ‘promenade’ এই দুই ছোট্ট শহরকে জুড়েছে। পাশে সারি সারি রেস্টুরেন্টে নানা রকম সামুদ্রিক মাছের ঢালাও আয়োজন, রেস্টুরেন্ট গুলোয় মাছ ভাজার গন্ধ ভুর ভুর করছে।
সমুদ্র তীরের এই ছোট্ট শহরে মাছ ধরা এক অন্যতম পেশা ছিল, তাছাড়া ওয়াইন অলিভ অয়েল ইত্যাদি তৈরি হত। এখন অন্যতম টুরিস্ট বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট শহর বলেই পর্তুগিজদের কাছে পরিচিত। 19th century ও 20th century র প্রথমে এই ছোট্ট সমুদ্র শহর ‘Cascais’ পর্তুগালের রাজ পরিবারের ছুটি কাটানোর জায়গা ছিল। সেই রেশ যেন এখনও রয়ে গেছে এই শহরের বাতাসে, পর্তুগালের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ধনী মানুষের বাস এই শহরে।
সমুদ্র এখানে পাথুরে তীরে সজোরে আছড়ে পড়ে, তাই জায়গায় জায়গায় সতর্কবানী লেখা – সমুদ্রে সাঁতার নিজের দায়িত্বে। তবে পর্তুগিজদের রক্ত বোধহয় সমুদ্রের নুনেই লবণাক্ত হয়েছে। সমুদ্রের ছন্দে এদের জীবনের ছন্দ বাঁধা। এই সকালেই বহু মাছ ধরার নৌকো জলে ভাসছে, অনেকেই পাথুরে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে সাঁতার কাটছে বা রোদ্র স্নান করছে। কেউ কেউ আবার সমুদ্রে ছিপ ফেলে মাছ ধরার সাধনা করছে।
জুলাইয়ের দুপুরে সূর্য যদিও মধ্য গগনে উত্তাপ ঢালছে, কিন্তু সাথে সাথে সমুদ্রের ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া জুড়িয়ে দিচ্ছে। মাঝে এক রেস্টুরেন্টে বসে মাছ ভাজা সহযোগে দুপুরের খাবার সারা হয়ে গেল।
উদার অ্যাটল্যান্টিক সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে আবার হাঁটা শুরু, ম্যাপে যখন খুঁজি কোথায় Estoril, কোথায় Cascais – এক অদ্ভুত আনন্দে দ্রবীভূত হই, ভাবি পৃথিবীর পথে মানুষের পথ চলায় কতই না বাঁক আসে। আর সেই বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে কতই না অচেনা কথা, অচেনা জীবন, অচেনা পথ, অচেনা আনন্দ। আর সেই অচেনার দিকে হেঁটে যাওয়াই যে জীবনের আরেক নাম – ‘অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে…’