রতু বাবুর তৎকাল টিকিট

রতু বাবু জীবনে ট্রেনের তৎকাল টিকিট কাটেন নি, কি ভাবে কাটে জানেন না। মধুপুর ষ্টেশন মাস্টারের কাছে রতু বাবু যখন বললেন, শুনে অনেকে চমকে যেতেই পারে, আজকের এই তৎকাল টিকিট কাটার যুগে দরকারে অদরকারে ছেলে ছোকরারা হরদম তৎকালে টিকিট কেটে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ আবার হয় নাকি – জীবনে তৎকাল টিকিট কাটেন নি! তাছাড়া ট্রেনের তৎকাল কাটা তো এক স্ট্যাটাস সিম্বল, কারণ তৎকাল শুনতে যত সহজ কাজে ততটাই কঠিন, টাকাও বেশী লাগে।

তৎকালে এক টিকিট কাটতে লোকের রাতের ঘুম উড়ে যায়, ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে এক মাইল লম্বা ট্রেন ছোট হয় সেখানে ট্রেনের এক তৎকাল টিকিট পাওয়া যে কতখানি কঠিন তা শুধু ভুক্তভুগিরাই জানে। ট্রেনের তৎকাল টিকিটের জন্যে বোধহয় ভারতবর্ষে কোন এক নতুন দেবতার আবির্ভাব হয়ে তাঁর কাছে মানত করাও শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। রতু বাবুর এই নবিশতার কথা শুনে অবশ্য মধুপুরের মানুষ চমকায় না।

ওরা জানে রতু বাবু জীবনে অনেক কিছুই করেন নি – যেমন ব্যাঙ্কের এ টি এম কার্ড কখনোই ব্যাবহার করেন নি, মোবাইল ব্যাবহার করেন নি, ইন্টারনেটে ফেসবুক করেন নি, বাইক চালান নি। পুরাতন পন্থী রতু বাবু আধুনিকতার এই সব উটকো ঝামেলা যতটা পারেন এড়িয়ে চলেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইলেকট্রিক বা ফোনের বিল জমা দেওয়া যদিও ভারতবর্ষে বহুদিন ধরে চলে আসছে, ওনার ছেলেরা তা ব্যবহারও করছে কিন্তু রতু বাবু এই সব সহজ চট জলদি কাজের ঘোর বিরোধী। মধুপুরের বৈশাখের গরমে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গলদ ঘর্ম হয়ে ফোনের বিল জমা দেওয়া, কিংবা ব্যাঙ্কের চালান কেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে টাকা তোলা রতু বাবুর প্রিয় কাজের মধ্যে অন্যতম।

পেশায় রতু বাবু উকিল, আইনের সমস্ত ঘোর প্যাঁচ রতু বাবুর মুখে মুখে, কিন্তু টেকনোলোজির বাড় বাড়ন্ত ওনার একদম পোষায় না। প্রতিদিন সকালে নানান ধরণের খবরের কাগজ কিনে পড়া ওনার বহুকালের অভ্যেস। তবে, ওনার স্ত্রী খুবই আধুনিক, রতু বাবু যা যা করেন নি সবই ওনার স্ত্রী তৃষ্ণা দেবীর দখলে। মধুপুরের সমস্ত বড় ব্যাঙ্কের এ টি এম কার্ড, আধুনিক মোবাইল ইত্যাদি নিয়ে তিনি আধুনিকতার এক কাণ্ডারি।

যাইহোক, রতু বাবুর কথা শুনে ষ্টেশন মাস্টার বললেন, যে তিনি ওনাকে সাহায্য করবেন তৎকাল টিকিট কাটার ব্যাপারে। যে কাজ রতু বাবু আগে করেন নি এখন হঠাৎ কেন করতে হচ্ছে? ঐ যে বললাম ওনার স্ত্রী আধুনিকতার কাণ্ডারি, বড় ছেলে থাকে গুজরাটে, হঠাৎ যেতে হবে ছেলের কাছে। ট্রেনের টিকিট তো চাই, যদিও ছেলে বলেছিল ফ্লাইটে টিকিট কেটে দেবে কিন্তু রতু বাবু তো ফ্লাইটে চড়েনই নি, তাই তৃষ্ণা দেবিকে ফ্লাইট থেকে বিরত করলেন।

বহুদিন ধরে নানান জল্পনা –কল্পনা, তর্ক – বিতর্কের শেষে বহু অপেক্ষিত সেই তৎকাল টিকিট কাটার দিনটি এগিয়ে এলো। রাতে রতু বাবুর চোখে ঘুম নেই, সূর্য ওঠার অপেক্ষায় রাত কেটে গেল। ভোর ভোরে তৎকাল টিকিটের লাইনে তিনিই প্রথম। মনে মনে এক আত্ম তৃপ্তি বোধ করলেন, জীবনের প্রথম তৎকাল টিকিটের লাইনে তিনিই প্রথম। মধুপুরের রেল ষ্টেশনের নিয়ম হল, যে আগে এসেছে তার নাম একজন রেল কর্মী লিখে রাখে, পরে দশটার সময় তৎকাল কাউন্তার খুললে সেই লিস্ট ধরে নাম ডাকে। অনেকটা ঠিক ডাক্তারের কাছে নাম লেখানোর মত। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে দেখার পর আবার আট টা বাজতেই রতু বাবু তৎকালের কাউন্তারে দাঁড়িয়ে গেলেন।

যথারীতি সময়ানুসারে তৎকাল কাউন্তারের সামনে সকালে লেখানো নামের এক লিস্ট টাঙ্গিয়ে দেওয়া হল। অবাক হয়ে রতু বাবু দেখলেন আরে ওনার নাম তো ১৫ নম্বরে লেখা আছে। এতো সকালে এসেও নাম পনেরোতে? আর তো তৎকাল টিকিট পাওয়া যাবে না।

মাথাটা একদম তেতে উঠল, রাগে গা রি রি করতে লাগলো রতু বাবুর। জীবনে রতু বাবু অন্যায় সহ্য করেন নি, এক টাকাও ঘুষ কাউকে দেন নি, যে কাজ সহজ পথে আইন অনুসারে হয় সেই কাজ ঘুষ দিয়ে করার ঘোর বিরোধী তিনি। জীবনের সমস্ত কোর্ট কেস তিনি নিয়মানুসারে সৎপথে লড়েছেন। মধুপুরের সবাই প্রায় রতু বাবুকে চেনে, আর বেশ সমীহ করেই চলে। মধুপুরের জানা শোনা পরিধির ভেতরেই রতু বাবুর জীবন কেটেছে, বড় জোর কোলকাতা কিংবা রাঁচিতে কোর্টের কাজেই যেতে হয়েছে। অহেতুক দেশ বিদেশ ঘোরার কি দরকার যদি জীবন এক জায়গায় নিশ্চিন্তে কেটে যায়। তৃষ্ণা দেবী প্রায়ই অভিযোগ করেন রতু বাবুর এই ব্যবহারে – জীবনে তো কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলে না, সারাজীবন হেঁশেল সামলে গেলাম।

জীবনে যখন রাজপথ দিয়ে হাঁটার সুযোগ আছে তখন অহেতুক শুড়ি পথ ধরার কি প্রয়োজন? রতু  বাবু তাই বিশ্বাস করেন। নানান আদর্শে মোড়া সেই রতু বাবুর নাম পনেরো নম্বরে? এই দেশে জঙ্গলের নিয়ম চলে, সভ্যতা ভদ্রতার কেউই ধার ধারে না। এই অরাজকতার দেশে অন্যায়, অবিচার সহ্য করাই যখন নিয়ম সেখানে রতু  বাবুর মত মানুষেরা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, হয়তো কিছুদিন পর রতু বাবুর মত সৎ মানুষ দেখতে লোকে মিউজিয়াম যাবে।

তৎকাল টিকিট না পাওয়া তো আকছার হচ্ছে, পরে লোকে দালাল ধরে কিংবা রেল কর্মিকে ঘুষ দিয়ে  কোন মতে একটা টিকিট ঠিকই যোগাড় করে নেয়। কিন্তু, রতু বাবুর রাজপথে চলেন, রেল ষ্টেশনের ঠিক উল্টো দিকে এক থানা, সকাল সকাল রাগে কাঁপতে কাঁপতে রতুবাবু থানায় পৌঁছে গেলেন। তৎকাল টিকিট কাউন্তারে কি হারে জুয়াচুরি চলছে, সকালে প্রথম এসেও কি করে নাম পনেরোতে হয়? আগের ঐ পনেরো জনের নাম কোথা থেকে এলো, কোথায় সেই পনেরো জন ইত্যাদি প্রশ্নে থানা সরগরম হয়ে গেল। কোন কোন মানুষ আছে যাদের কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না, রতুবাবু সেই দলের মানুষ। থানার পুলিশও রতুবাবুকে জানে, এটাও জানে যদি রতুবাবুর সঙ্গে না যায় তৎকাল কাউন্তারে জুয়াচুরি না ধরতে পরের দৃশ্য কোর্টে হবে।

সকাল সকাল দারোগা বেশী ঝামেলা না বাড়িয়ে রতু বাবুর সঙ্গে তৎকাল কাউন্তারে গিয়ে সেই পনেরোটা নামের আগে রতু বাবুর নাম লিখে দিল ও অন্যরা যারাই উপস্থিত ছিল সবার নাম ক্রমানুসারে নতুন ভাবে লেখা হল, নতুন লিস্ট তৈরি হল। রতু বাবুও তৎকাল টিকিট পেয়ে গেলেন।

জনজীবনকে সহজ করার জন্যে সরকারের এক স্বাভাবিক পদক্ষেপও এই দেশে চলে যায় দালালের হাতে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায় প্রতিদিনের এই সব ছোট খাটো লড়াইয়ে। সাধারণ মানুষের জীবন সহজ করার জন্যে রতুবাবুর মত মানুষের কাজ হয়তো সিন্ধুতে বিন্দু, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না বিন্দু বিন্দুই সিন্ধু।

অজানা's avatar

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Inspirational. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান