September 2013, Charles Bridge, Prague
নীল সন্ধ্যা নামছে এক ঐতিহাসিক রূপকথার শহরে। চার্লস ব্রিজের উপরে জনস্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে চোখ রেখেছি Vltava নদীর বুকে। সন্ধ্যার এই প্রাক্বালে ক্লান্ত ডানায় সিগালেরা রোদের গন্ধ মুছে ফেলে, আশ্রয় খুঁজছে চার্লস ব্রিজের নীচে জলের বুকে জেগে থাকা কাঠের ঢালু পাটাতনে। ওদের সান্ধ্য সিগালিয় আলাপন শোনা যায়। হঠাৎ শোনা যায় নদীর বুকে ছোট জাহাজের ভোঁ। চমকে অনেকেই তাকায়। অনেকেই কায়াক ভাসিয়েছে জলের বুকে।
উদার নদীর দু’পাশে ঐতিহাসিক স্থাপত্যে সত্যি মনে হয় এই শহর যেন রূপকথা থেকেই উঠে এসেছে। একপাশে দূরে পাহাড়ের উপরে দেখা যায় প্রাগ ক্যাসল, ক্যাসলের ওপাশে অস্তগামী সূর্য নীল আকাশে লাল আবীর ছড়িয়ে ছবি আঁকতে ব্যস্ত।
সন্ধ্যায় এই সেতুর উপরে বসেছে সঙ্গীতের আসর। এক ভদ্রলোক নানান মাপের গ্লাসে জল ভরে বাজিয়ে চলেছেন জলতরঙ্গ, তাঁর হাতের ছোঁয়ায় জলভরা গ্লাস বেঠোভেনের (Beethoven) সুর তুলেছে। তাঁকে ঘিরে শ্রোতারা মাঝে মাঝেই হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে, সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়েছে চার্লস ব্রিজে।
১৪ শতকে তৈরি পাথরের এই ব্রিজ প্রাগ শহরের দুই পাশকে জুড়েছে, প্রাগে এই ব্রিজকে ঘিরে বহু গল্প প্রচলিত। এই ব্রিজ শুধু নদী পারাপারের সেতু নয়, এ যেন এই শহরের শিল্পকলা, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। চার্লস ব্রিজ যেন প্রাগের প্রতীক। এই ব্রিজ শুধুই হাঁটার জন্যে, গাড়ি চলাচল নিষেধ।
১৬ শতকের শেষে ও সতেরো শতকের শুরুতে এই ব্রিজের দু’পাশে রেলিংএর উপরে নানা সন্তের স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়েছে। বারোক স্টাইলে তৈরি এই মূর্তি গুলোই এই ব্রিজের অলঙ্কার, ও প্রধান আকর্ষণ। এখন এখানে প্রায় পঁচাত্তরটা মূর্তি আছে, বন্যায় অনেকবার মূর্তি গুলো খারাপও হয়েছে।
অনেক ব্রঞ্জের মূর্তির পদতল মানুষের হাতের ঘষায় চকচকে হয়ে উঠেছে। এখানের মানুষ বিশ্বাস করে এই ব্রিজের নানা মূর্তির নানা অজাগতিক ক্ষমতা আছে, নানা মূর্তির নানা অলৌকিক শক্তির গল্প ফেরে এখানের মানুষের মুখে। তাই অনেকেই মূর্তির পায়ে হাত দেয়, ফটো তোলে। সবচেয়ে পুরনো ও বিখ্যাত মূর্তি Saint John of Nepomuk এর পদতলে হাত দেওয়ার জন্যে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে।
কথিত আছে, Saint John of Nepomuk কে নাকি এই জায়গা থেকেই রাজার আদেশে জলে ফেলা হয়েছিল, Saint John রাজার এক শত্রু বিশপকে নিমন্ত্রণ করায় রাজা রেগে তাঁকে এই শাস্তি দেন। প্রাগের প্রথা এই মূর্তির পায়ে হাত দিয়ে মনস্কামনা করা। অলৌকিক শক্তির প্রতি মানুষের অন্ধ বিশ্বাস বোধহয় সব দেশে, সব কালে সমান।
দিনের শেষে অনেকেই এখানে সান্ধ্য ভ্রমনে এসেছে, সারাদিনে এই ব্রিজের দু’পাশে ছোট ছোট দোকান বসে – স্যুভেনির, কানের দুল, ছোট বাশি, কার্টুন ছবি আঁকার চিত্রকর, বাজনা বাদক আরও কতো কি। সবাই দিনের শেষে গুছিয়ে নিচ্ছে দোকান। এখন এই ব্রিজে শুধুই মানুষ।
সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে অনেকেই ফটো তোলার জন্যে অপেক্ষা করছে, অনেকে ঘুরছে ধীর পদক্ষেপে। হাসি আনন্দে ভরা চার্লস ব্রিজের পরিবেশ। সবাই যেন শান্ত সন্ধ্যাকে স্বাগত জানাচ্ছে শান্ত ভাবে। শান্ত, মার্জিত ভিড়ের কথাবার্তা ছাপিয়ে বেঠোভেনের সুর এক রোম্যান্টিক পরিবেশ তৈরি করেছে।
ধীরে ধীরে সারা শহরে, দূরের ক্যাসলে, ব্রিজের দু’প্রান্তের টাওয়ার গুলোয় আলো জ্বলে ওঠে, আলোর মালায় সাজে। রাতের আলোয় এই ঐতিহাসিক রহস্য নগরী যেন আরও বেশী মোহময় রূপকথা হয়ে ওঠে।
সাঁঝবেলার এই রূপকথা নগরীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কোন এক অতীতে যেন ডুবসাঁতার দিয়েছি। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে এই সন্ধ্যা ধরে রাখতে বেঁচে থাকি হাজার বছর কিংবা আজই মারা যাই।