July 2011, Cordes-Sur-Ciel, France
তুলুস থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপরে মধ্য যুগের এক সুন্দর ছোট্ট, পাহাড়ি দুর্গ শহর কর্ড সু সিয়েল (Cordes-sur-Ciel), আগে নাম ছিল কর্ড, এখন নতুন নাম করণ হয়েছে Cordes-sur-Ciel, মানে আকাশে তৈরি শহর।
দক্ষিণ ফ্রান্সের পাহাড়ের উপরে এই মধ্য যুগের শহরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। শীতে যখন চারিদিকের সমতল ভূমিতে কুয়াশা ছেয়ে থাকে, পাহাড়ের উপরে এই দুর্গ শহরটিতে সূর্যের আলো খেলা করে আর দূর থেকে মনে হয় যেন আকাশেই শহরটি অবস্থিত।
ফ্রান্সের অনেক সুন্দর গ্রাম-শহর গুলির মধ্যে অন্যতম সুন্দর এই গ্রামীণ শহর। জুলাইয়ের গরমের ছুটিতে এক সকালে বেড়িয়ে পড়া গেল। এই শহরের পাশে কোন রেল ষ্টেশন নেই। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক ছোট্ট রেল ষ্টেশন, দিনে মাত্র দু’বার ট্রেন চলে। ছোট্ট শান্ত রেল ষ্টেশনে এক জন মাত্র লোক নামলো আর আমরা।
ভুল এলাম নাকি? আমাকে সবাই প্রশ্ন করল, আমিই টিকিট কেটেছিলাম, আমিই জেনেছিলাম এই সুন্দর স্বর্গ-শহরের কথা। ষ্টেশনের সামনেই জনমানব বিরল চাষের খেত, এখন শুধু খড়গুলোকে গোল গোল করে রাখা। ষ্টেশনের ভেতরে দেখলাম এক স্থানীয় মানুষ, তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বেশ হেসেই দিগন্তের দিকে হাত দেখালেন, বললেন – ‘ঐ যে, কিন্তু বেশ দূর যাবে কি করে?’ একটু ভেবে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন – ‘তাহলে এই ভাবে যাওয়ার চেষ্টা কর।’
লিফট নেব না হাঁটব? বেশ তাহলে হেঁটেই যাওয়া যাক। শুরু হল মাঠ ঘাট ভেদ করে দূরের আকাশের স্বর্গ-শহর লক্ষ্য করে হাঁটা। মাঠে খড়ের গাদি পড়ে আছে, সকালের সোনালি রোদ এখনও নরম, হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল।
তুলুসের কাউন্ট Raimon VII এর বাড়ী ছিল এই শহর, সম্পূর্ণ পাথরের এই শহরের প্রতিষ্ঠা হয় ১২২২ সালে। সেই পুরোন দিনে মাত্র সাত বছর সময়ে এই শহর তৈরি হয়।
অতীতের কোন এক সময়ে এই শহর ছিল উন্নতিশীল, ব্যবসা বানিজ্যের কেন্দ্র। বাড়ছিল কাপড়, উল ও চামড়ার ব্যবসা। এমনকি অর্থনীতিতেই এই শহর দৃঢ় ছিল।
খুব দ্রুত এই শহরে বাসিন্দার সংখ্যা বাড়ছিল। কিন্তু ১৩৪৮ এ Black plague এই শহরের এক চতুর্থ জনসংখ্যা মুছে ফেলে। ব্যবসাদারদের গথিক স্ট্যাইলে তৈরি বাড়ী এখনও দেখা যায়, বলা যেতে পারে এই পুরোন শহর মূল্যবান ঐতিহাসিক গথিক আর্কিটেকচারের গুপ্তধন।
অনেক শতক ধরে অনেক আক্রমণ, মৃত্যু, যুদ্ধ বিগ্রহের সাক্ষী এই শহর। এই শহরের আশেপাশে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষের বসবাসের নিদর্শন পাওয়া যায়। অনেক পরে রোমান গল এই শহর দখল করে নিজেদের আরামপ্রদ আস্থানা তৈরি করেছিল, তার নিদর্শন এখনও বিদ্যমান।
জুলাইয়ের দুরন্ত গরম এই শহরে অনুভব হয় না, প্রচুর হাওয়া, খোলা চারিধার। দূরে দেখা যায় আঙুর খেত। পাহাড়ি পাথুরে রাস্তা এই শহরে।
এখন এই শহর শুধু টুরিস্টদের জন্য, গরমের সময়ে নানা দিক থেকে টুরিস্টের আগমন হয় এখানে। এই ঐতিহাসিক শহরে বাসিন্দা এখন খুবই কম। এই সময়ে এই শহরে মধ্য যুগের উৎসব হয়, প্রায় অনেকে মধ্য যুগের পোশাকে ঘোড়ায় চড়ে বা মধ্য যুগের যুদ্ধের শহর প্রদক্ষিণ করে।
সারাদিন এই শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে ক্লান্ত। ফেরার সময় সুন্দর রাস্তা, হাওয়া, বড় গাছের ছায়া, দিগন্ত বিস্তৃত সূর্যমুখী ফুলের খেত পথ চলার ক্লান্তি মুছে দিচ্ছিল।