July 2013, Finland
হেলসিঙ্কির আশেপাশে আছে আরচিপিলাগো। সবচেয়ে সুন্দর, মনোরম দ্বীপ হল সুমেনলিনা (Suomenlinna)।পুরো দ্বীপের সীমানা জুড়ে দূর্গের মত মোটা প্রাচীর, সৈনিকদের থাকার পরিত্যক্ত বাঙ্কার, সমুদ্রের দিকে মুখ করে সারি সারি পুরনো দিনের কামান রাখা । পুরোন দিনের পাহারার সমস্ত ব্যাবস্থা নিয়ে এই দ্বীপের অবস্থান, কিন্তু এখন পুরো দ্বীপটিই UNESCO world heritage site।
এখানে এলে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ফিনল্যান্ডের অবস্থান বোঝা যায়, শেষ সীমানা বোঝা যায়। প্রথমে সুইডেন তারপর রাশিয়া অবশেষে ফিনল্যান্ড এই তিনটে ঐতিহাসিক যুগ ধরে এই দ্বীপের ইতিহাস গড়েছে।
এখন এই দ্বীপে সৈনিকদের ছন্দ বদ্ধ হাঁটার শব্দ নেই, বারুদের গন্ধ নেই – আছে এক অপার উদারতা, নিবিড় শান্তি। যত দূর চোখ যায় আকাশ ও সমুদ্রের মিলন দেখা যায়, দেখা যায় আরও ছোট ছোট ফিনিশ দ্বীপ।
মিউজিয়াম, চার্চ, ক্যাফেটেরিয়া, রেস্টুরেন্ট, বাচ্চাদের খেলার পার্ক সবই আছে এখানে, গরমের সময় হেলসিঙ্কির মানুষের প্রিয় জায়গা এই দ্বীপ। শুধু যে ঐতিহাসিক দুর্গ দ্বীপের টানে মানুষ এখানে আসে তা নয়, প্রকৃতিও এখানে সবুজ, উদার, বিস্তারিত, প্রসারিত।
জুলাইয়ের এই সময় সারা দ্বীপে লাইলাক ঝোপে প্রচুর ফুল ফোটে, তার সুগন্ধে সারাটা দ্বীপে এক অদ্ভুত মাদকতা ছড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে লাইল্যাক ফুলের মাতাল করা সুগন্ধে ঘোর লাগে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সেই সুগন্ধ যেন নিজের সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। বহু আগে এই দ্বীপে সৈনিকরা কখনও এই ফুলের ঝোপ লাগিয়েছিল, আজও এরা সুগন্ধ বিলায়।
দ্বীপে ঢোকার মুখেই দেখা যায় উঁচু চার্চ- সুমেনলিনা চার্চ। প্রথমে ছিল রাশিয়ান গোঁড়া চার্চ, গম্বুজ গুলো ছিল পেঁয়াজের মত। ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতার পরেই সেই আকার বদলে দেওয়া হল। উঁচু এই চার্চ লাইট হাউস হিসাবেও কাজ করে। এখনও এই লাইট হাউস মাঝ সমুদ্রের জাহাজদের আলো দিয়ে পথ দেখায়। এই লাইট হাউস এখনও সেই পুরোন পদ্ধতিতে Morse Code এ চারবার লাইটের ঝলক দিয়ে জানান দেয় হেলসিঙ্কির ‘H’ অক্ষর।
১৮ শতকে Tykkisluuppi নামে এক জাহাজ ছিল, এই দ্বীপে সেই জাহাজের পুরোন নক্সা দেখে আবার সেরকম জাহাজ তৈরি হচ্ছে। এই জাহাজ আবার জলে ভাসবে, টুরিস্টদের মনোরঞ্জন ও বিনোদনের জন্যে।
এই দূর্গ দ্বীপের মোটা প্রাচীরে অন্ধকার ও বহুকালের পরিত্যক্ত প্রচুর গুহা আছে। তিন শাসক যুগ ধরে সৈনিকদের বাসস্থান ও পাহারা দেওয়ার জন্যে লুকোনোর জায়গা ছিল এইসব গুহা। আজ গুহা গুলোয় শুধু বুনো কুকুর, গিরগিটি, সাপ, বাদুড়, বুনো খরগোশ ইত্যাদির বাস। অনেকে দেখছি টর্চ নিয়ে সেই পরিত্যক্ত গুহা গুলোয় ঢুকছে, ঐতিহাসিক অন্ধকারের রহস্য আবিষ্কারের জন্য। এই দ্বীপের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যারা আছে তাঁরা বার বার বলে দিয়েছে এই অন্ধকার গুহায় ঢুকতে হলে নিজের দ্বায়িত্বে, কারণ এই সব গুহা গুলো বহুদিন ধরে কোন সংস্কার হয় নি।
সমুদ্রের নীল ও আকাশের নীলের মেলামেশা আর সবুজ দ্বীপ এক অপরূপ ছবি তৈরি করেছে। দ্বীপে ফুটে আছে প্রচুর বেগুনি-হলুদ-সাদা নাম না জানা নানান ফুল।
এখানে শেষ বেলার পড়ন্ত রোদে সুমেনলিনা দ্বীপকে সাজতে দেখলাম এক কনে দেখা আলোয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে যতই দেখি চোখ দিয়ে ততই দেখি ক্যামেরা দিয়ে। ফিরে আসি নিজের ঘরে স্মৃতির সম্ভার নিয়ে।