October 2012, Gothenburg, Sweden
কিরণ সুস্মিতা গথেনবারগ ষ্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। রাত এগারোটায় আমারা পৌঁছলাম । স্টকহোমের তুলনায় ঠাণ্ডা বেশ কম । ট্রামে করে পৌঁছে গেলাম ওদের বাড়ি। ওরা আমাদের জন্য বাহাত্তর ঘণ্টার একটা টিকিট কেটে রেখেছিল। গথেনবারগে থাকা কালীন এই টিকিটেতেই সমস্ত গথেনবারগ বাসে ট্রামে ফেরিতে ঘোরা যাবে।
বহুদিন পরে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে যা স্বাভাবিক তাই হল। মানে কিচির মিচির করে কথা বলতে বলতে নানান খোঁজখবর নিতে নিতে ওদের বাড়ী পৌঁছে গেলাম। রাতের শহরটাকে খুব একটা বুঝতেও পারলাম না।
এখানে এসে আমাদের আর দ্রষ্টব্য স্থানের লিস্টের দরকার নেই। এবার আমাদের ঘোরানোর সমস্ত দায়িত্ব কিরণ ও সুস্মিতাদের, মানে কোথায় যেতে হবে কি করতে হবে সব এবার ওরা বলে দেবে। ওদের আথিতেয়তার সীমা নেই।
পরের দিন সুস্মিতা আমাদের গথেনবারগ ঘুরিয়ে দেখাল। বেশ সুন্দর শহর। এই শহরকে জড়িয়ে আছে Gota নদী। ট্রামে চড়ে চলে গেলাম হাগা, এখানে এক সুন্দর চার্চ আছে।
হাগা চার্চ দেখে হাঁটতে লাগলাম শহরের রাস্তা ধরে। দেখে নিলাম ফিস চার্চ। অদ্ভুত ধরনের মাছের বাজার, সুইডিশ ভাষায় Feskekorka। এখানে প্রতিদিন তাজা সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। এই মাছের বাজারে ঢোকা মাত্র সামুদ্রিক মাছের বোটকা গন্ধের ধাক্কায় বেরিয়ে এলাম খুবই তাড়াতাড়ি।
পথে যেতে যেতে শহরের মাঝে আরেক সুন্দর চার্চ ‘Oscar Fredrik Church’ আমাদের চলা থামিয়ে দিল।
এই শহরে প্রচুর গাছের সমারোহ। পুরো শহরের সমস্ত গাছের পাতাও হলুদ-লাল-কমলা। শুনেছি স্ক্যন্দেনাভিয়ায় এই সময়ে প্রকৃতি সাজে পাতাঝরার হলুদ-কমলা-লাল- গোলাপি রঙ্গে। শোনা কথা এখানে এসে চোখে দেখলাম।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে শহর দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পরে একটা ট্রামে চড়ে চলে গেলাম লিনেপ্লাস্তিন। লিনেপ্লাস্তিন এক বিরাট পার্ক। পার্কের সমস্ত সারি বাধা গাছের পাতায় সবুজ-হলুদ-কমলা রঙের খেলা, এক স্বপ্নে দেখা কোন জঙ্গল বলে মনে হল।
ইউরোপে আমাদের অনেক বছর থাকা হয়ে গেল, পাতা ঝরার রঙ দেখেছি অনেক বছর ধরে, কিন্তু স্ক্যন্দেনাভিয়ার জঙ্গলের পাতা ঝরার রঙ সত্যি অদ্ভুত সুন্দর।
হঠাৎ আবহাওয়া বদলে গেল। দুপরের পর থেকে আজ এখানে যেমন ঠাণ্ডা তেমনি মেঘলা আকাশ। দুপুরেই সন্ধ্যার ধূসর ভাব, ঘুরে বেড়ানোর জন্য দিনটা খুব একটা ভাল নয় তবে এক নতুন শহর দেখার যে রোমাঞ্চ তা এই মেঘলা দিনেও অনুভব করছি।
তিনটের দিকে শুরু হল বৃষ্টি সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। এখানে নাকি হাওয়ার গতিবেগ তীব্র, এবং প্রায় সারা বছরই হাওয়া চলে। সমুদ্রের বুক ছুঁয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দেয়। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণ পরেই শুরু হল ছোট ছোট শিলা বৃষ্টি। ঠিক শিলা বৃষ্টিও নয় খুব ছোট ছোট বরফের কুচি বৃষ্টির সঙ্গে পড়ছে, অনেকটা ব্লিজারডের মত। এখানে অক্টোবর মাসে নাকি মাঝে মাঝেই বৃষ্টির সঙ্গে এমন বরফের কুচি পড়ে। বেড়াতে গেলে বৃষ্টি হলে অনেকেরই রাগ হয়, ভাস্কর তাঁদের মধ্যে পড়ে, আমার কিন্তু মনে হয় বৃষ্টি দেখাটাও সেই জায়গার বৈশিষ্টের মধ্যে একটি। বৃষ্টি পড়লে ইউরোপের শহর গুলি আরও বেশি রহস্যময় আর ঐতিহাসিক বলে মনে হয়।
এবার আমাদের কিরণের ল্যাবরেটরিতে নিমন্ত্রণ। কিরণ বলে দিয়েছে ওর ল্যাবের জানালা দিয়ে নাকি Fall color খুব ভাল দেখা যাচ্ছে। ফটোগ্রাফি প্রিয় ভাস্করের পক্ষে কিরণের এই নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করা ভীষণ কঠিন।
বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে তিনজনে পৌঁছে গেলাম কিরণের ল্যাব। কিরণ ওর ল্যাবের ওভেনে রান্না করেছে গরম গরম Pineapple chicken with cheese আর কফি। উফ, এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় গরম ল্যাবে গরম কফি আর গরম মুরগি যেন মৃত সঞ্জীবনীর কাজ করেছে। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া তিনজনের যেন প্রান ফিরে এল। কথা ছিল কিরণের ল্যাব থেকে কিরণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ফেরিতে করে রাতের সমুদ্র ভ্রমণ করব। রাতের গথেনবারগ শহর জলপথে দেখব। কিন্তু এত ঠাণ্ডা পড়েছে সঙ্গে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হয়ে চলেছে, জানি না এই আবহাওয়ায় কতটুকু হবে। তবে উৎসাহের তো অভাব নেই।
ফেরিঘাটে পৌঁছে গেলাম চারজন ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, কিন্তু এই সময়ে ফেরিঘাটে জাহাজ চলাচল কমে যায়, আর আমাদের পৌঁছতেও একটু দেরি হয়েছিল। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে শেষ জাহাজ চলে গেল। আমাদের আজ আর রাতের সমুদ্রে জাহাজে চড়া হল না।
কিরণের উৎসাহ কিন্তু দমে নি, বলল- “চল তোদের আরেক জায়গায় নিয়ে যাই”।
কিছুটা হেঁটে চলে এলাম ‘গট গটি গট গট’। নামটা একটু মজার, আসলে এটা এক চকোলেটের দোকান। বলা যেতে পারে চকোলেটের পাইকারি দোকান। এখানের এই দোকানে প্রচুর চকোলেট। পুরো দোকান নীচ থেকে উপর পর্যন্ত চকোলেটে ঢাকা। আমারা সবাই প্রচুর চকোলেট কিনলাম ও খেলাম। এতো চকোলেট খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেল।
এবার ফিরে চলো ঘরে। দিন শেষ। গথেনবারগের প্রথম দিন বেশ ভালোই কাটল। রাস্তাতেই ঠিক করে নিল কিরণ আর সুস্মিতা রাতের খাবারের মেনু। আমি দেখেছি এই সময়ে ওদের খুব ভাব। অবশ্য অন্য সময়েও ভাব কিন্তু এই সময়ে ওদের ভাবটা একটু অন্য রকম। এই সময়ে ওরা একটু ফিস ফিস একটু কানে কানে কথা বলে। বেড়ানোর ক্লান্তি যাই হোক না কেন কিরণ আর সুস্মিতার আথিতেয়তায় কোন কার্পণ্য নেই।
পরেরদিনের উদ্যেশ্য গথেনবারগ আরচিপিলাগো।